top of page
Search

অশোক মিত্র : নির্জন মানুষ



 (আজ মে দিবস । ২০১৮ সালের এই দিনে চলে যান অশোক মিত্র । তাঁরই স্মরণে এই ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ ।)


ree

 জীবনে কিছু কিছু এত বড় মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি, ভালবাসা পেয়েছি, যে নিজেকে বড় সৌভাগ্যবান ঠাওরে জনান্তিকে বেশ আত্মতৃপ্তি অনুভব করি । আমার জীবনে তেমনই এক বটবৃক্ষ অশোক মিত্র ।


 এই মানুষটিই আমায় আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন আরেক বিরাট মানুষ অশোক সেনের সঙ্গে । আমার এবং আমার লেখার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি 'বারোমাসে'র বিদগ্ধ সম্পাদককে এত ভাল ভাল কথা বলেছিলেন যে, লজ্জাবনত আমি ঘরের এক কোণে সিঁটিয়ে গেলে, অশোকবাবু (সেন) সরাসরি আমায় বলেছিলেন, "আজ থেকে তোমায় প্রতি বছরের শারদীয়া 'বারোমাসে'র জন্য লেখা আমন্ত্রণ করছি ।" সে যে কী অনির্বচনীয় এক মুহূর্ত ! আমার সারা শরীরে তখন শিহরন । কবি-সাহিত্যিকদের কাছে 'বারোমাসে'র মর্যাদা যে কতখানি, তা বলে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে  না । সেই থেকে অশোকবাবু (সেন)-র মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখে গিয়েছি 'বারোমাসে' । এ আমার জীবনের এক বিরাট প্রাপ্তি । আর সেই প্রাপ্তির মূলে এই মানুষটি--অশোক মিত্র ।


 নিরহংকার, সদালাপী, জ্ঞানতাপস, ঈশ্বরের মতো নিষ্কলঙ্ক এই মানুষটির চরণস্পর্শে সমৃদ্ধ হয়েছি বহুবার । শেষদিকে তিনি আর শুনতে পেতেন না কানে । তাই টেলিফোন করা বন্ধই করে দিয়েছিলাম । দেখা করতাম ওঁর বাড়িতে গিয়ে । লিখে লিখে কথা বলতাম ওঁর সঙ্গে ।


ree

 মানুষটির শেষ জীবন ছিল বিপন্নতায় ভরা । গৌরী জেঠিমা তাঁকে একা করে দিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি দিয়েছিলেন ২০০৮ সালের মে মাসে । সেই থেকে ২০১৮-র মে ! মানে পাক্কা একটা দশক ! না, কেউ ছিল না তাঁর, তাঁকে দেখার, দু'দণ্ড পাশে বসার, দুটো কথা বলার, একটু যত্ন করার, ভালবাসার ।


 অথচ এই মানুষটিরই যৌবনের দিনগুলোর দিকে তাকান । বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিক্স হয়ে নেদারল্যান্ডসের রটরডাম ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট এই ঋজু ঋতম্ভর মানুষটিকে কে না চেনেন ? ইন্দিরা গান্ধীর জামানায় দেশের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মিত্র সে দায়িত্ব ছেড়ে এসে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী হলেন । টানা দশ বছর মন্ত্রিত্ব করলেন দাপটের সঙ্গে । কিন্তু আপসহীন মানুষ তিনি, মনান্তর হল খোদ মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গেই । সঙ্গে সঙ্গে ইস্তফা । আর ১৯৯০-এ  রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত হলে শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের পদও অলংকৃত করেছিলেন তিনি, আমরা সবাই জানি । কমিউনিস্ট ভাবনাচিন্তা এবং 'বিকল্প অর্থনীতি'র ভাবনা থেকে অবশ্য নিজেকে কখনও বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি সারা জীবনে । সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে তৎকালীন বাম সরকারের নীতির কঠোর সমালোচনা করলেও, ২০১১ বিধানসভার আগে 'পরিবর্তনপন্থী' বিদ্বজ্জনেদের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত করতে সম্মত হননি তিনি ।


ree

 আর লেখালিখি ? তিনি যদি রাজনীতি না-ই করতেন, একজন লেখক হিসেবেই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন এই বাংলায় । বাংলা-ইংরেজি দু'ভাষাতেই তাঁর অবিস্মরণীয় প্রবন্ধের স্বাদ আমরা পেয়েছি । 'অচেনাকে চিনে-চিনে', 'কবিতা থেকে মিছিলে', 'নাস্তিকতার বাইরে', 'আপিলা-চাপিলা'...এ সব বই বাংলা সাহিত্যের সম্পদ । আর 'তাল-বেতাল' গ্রন্থের জন্য তো পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার ।


 অথচ তাঁর শেষ দিনগুলো কত অসহায়, কত অন্ধকার, কত নির্জন ! ভাবতে চোখে জল এসে যায়, এত বড় মানুষটিকে সঙ্গ দেওয়ার কেউ ছিল না এই বিরাট পৃথিবীতে । বধিরতা সহ বয়সজনিত অন্যান্য সমস্যার মধ্যেই পড়ে গিয়ে কোমরের হাড় ভাঙে । ফুসফুসেরও কিছু সাধারণ সমস্যা ছিল । সব মিলিয়ে ভগ্ন শরীরে তাঁকে এপ্রিল মাসের ১ তারিখে নিয়ে যাওয়া হয় গোর্কি সদনের ঠিক উলটোদিকে সুবীর চ্যাটার্জির নার্সিংহোম 'পার্ক ক্লিনিকে' । সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ নির্জন মানুষটিকে ভর্তি করে নেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ । রাইস টিউবে খাওয়ানো হয় তাঁকে । পাক্কা ১ মাস হাসপাতাল যাপনের পর, মে দিবসের সকালেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৯০ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যান প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, লেখক ও পশ্চিমবঙ্গের দোর্দণ্ডপ্রতাপ অর্থমন্ত্রী ড. অশোক মিত্র ।



(সমাজ মাধ্যমে প্রকাশিত এই লেখাটির সংক্ষিপ্ত রূপ কবি হিন্দোল ভট্টাচার্যের অনুরোধে তাঁর সম্পাদিত 'আবহমান' পত্রিকায় 'স্মরণ: অশোক মিত্র' শিরোনামে ছাপা হয়েছিল ।

ছবিঋণ : দ্য হিন্দু ও আনন্দবাজার পত্রিকা ।)

 
 
 

Comments


bottom of page