সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন...
- rajatsubhrablog
- Jan 19, 2024
- 3 min read
(আজ ১৯ জানুয়ারি । সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন । গুণীজনের হৃদয়ে তাঁর স্থান অবিনশ্বর । আমার জীবনে তিনি ধ্রুবতারার মতো । প্রতিবারের মতো সকাল-সকাল তাঁকে প্রণাম করে দিনের কাজ শুরু ।)

মনে হয় এই তো সে দিন ! তাঁর সঙ্গে লাস্ট স্টেজ শো করলাম । ২০১৮-র অক্টোবরে । নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই তিনি হলে এসে উপস্থিত ! গ্রিনরুমে ঢুকে পড়ে খোঁজ করছেন আমার, "রজতশুভ্র কোথায় ?" আয়োজকরা তো অবাক, "আপনাকে আনতে গাড়ি পাঠিয়েছি তো !"
"হ্যাঁ, তা পাঠিয়েছেন, কিন্তু..."
"কিন্তু ?"
"একটা শো সেরে আমি আর বাড়ি ঢুকলাম না, যদি এখানে আসতে দেরি হয়ে যায় ?"

এই হচ্ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় !
তারপর টানা দেড় ঘণ্টা আমার কবিতা পড়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিলেন দর্শকদের । সে কথা আনন্দবাজার লিখেছে, টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে । আরও অনেক মিডিয়া লিখেছে, দেখিয়েছে । মহাজাতি সদন উপচে পড়া দর্শক সে দিন সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করলেন ! সৌমিত্রদা বললেন, "আপনাদের জন্যই তো আমার বেঁচে থাকা !" কী অপূর্ব সেই মুখখানা, যেন জ্যোৎস্নালোকিত হিমালয়ের মুখ ! এ মুখের কোনও মালিন্য হয় না ! এ মুখের কোনও বয়স হয় না ! এ মুখের কোনও মৃত্যু হয় না !
সৌমিত্রদা আছেন । সৌমিত্রদা থাকবেন ।
মাঝে মাঝে ভাবি, এই মানুষটাকেও কত সময়ে কত হেনস্তার শিকার হতে হয়েছিল । এমনকী, শেষ বয়সেও । একটা ঘটনার কথা খুব মনে পড়ছে । ওয়ান ফাইন মর্নিং বাঙালি হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাকি খুব খারাপ মানুষ ! সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে ঘৃণা উদ্গীরণ শুরু হল । ফেসবুকসর্বস্ব কুনো বাঙালি এমন কথাও লিখে ফেললেন, তাঁরা নাকি আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছবি দেখবেন না ( আহা রে, তাঁর ছবি না দেখলে কী ক্ষতিই না হয়ে যাবে সৌমিত্রদার ! ) ! কারণ কী, না তিনি নাকি আজ থেকে বহু বছর আগে একবার প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের গায়ে হাত তুলেছিলেন ! সংবাদ প্রতিদিন নাম্নী খবরের কাগজ নাকি এই সত্য ফাঁস করে দিয়েছে ( 'মৃণালদা না বাঁচালে ঋত্বিককে আরও মারতাম', সংবাদ প্রতিদিন, ১২ মে, ২০১৮ ) !

আসল কাহিনি শুনুন তা হলে । সুরাপাগল ঋত্বিক ঘটকের উপর্যুপরি মাতলামির নানা কিংবদন্তি বাঙালিমাত্রেই জানেন । ওই অবস্থাতেই ঋত্বিকবাবু একবার সৌমিত্রদাকে ছাপার অযোগ্য ভাষায় গালাগালি করেছিলেন । সৌমিত্রদা সেটা সহ্য করতে না পেরে তাঁর সুরারঞ্জিত মুখে ঘুষি চালিয়ে দিয়েছিলেন । আড্ডায় ছিলেন মৃণাল সেনও । তিনিই তৎপর হয়ে অবাঞ্ছিত ঘটনাটি সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দেন । সৌমিত্রদার ভাষায়, "হঠাৎ ঋত্বিক এসে হাজির । দেখলাম মদে পুরো চুর । এসেই ধর্মঘটিদের গালাগাল শুরু করল । সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে যখন শুরু করল, তখনও আমি চুপ ছিলাম । সত্যজিৎ এমন মহীরুহ যে, কে কী বলল তাতে তাঁর কিছু আসে-যায় না । কিন্তু আমি তো চোখের সামনে বসে আমাকে অশ্রাব্য গালাগাল করার রাইট কাউকে দিইনি । সহ্য করব কেন ?...বেঞ্চে বসে ছিল ঋত্বিক । সপাটে একটা ঘুষি মারি । পড়েই যেত । মৃণালদা বাঁচিয়ে দিলেন ।"
ব্যস, এটুকুই ঘটনা, বাদবাকি সমস্তটাই রটনা--সংবাদ প্রতিদিনের বানানো গল্প । যাই হোক, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সৌমিত্রদা শতহস্ত দূরে থাকতেন । ফেসবুক-টুইটার সম্পর্কে তাঁর বিশেষ কোনও ধারণাই ছিল না । তাই তাঁকে সমস্ত বিষয়টিই অবহিত করলাম । সব শুনে তো তিনি থ ! অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ভারী গলায় বললেন, লেখাটি ছাপা হওয়ার পর তিনি আর পড়ে দেখেননি । রসালো গল্প লেখার প্রয়োজনে অনুলেখক অনেক কিছুই যোগ করেছেন যা তিনি বলেননি । এই ধারাবাহিকটি তিনি আর চালাবেন না, বন্ধ করে দেবেন । সংবাদ প্রতিদিনের সঙ্গে তাঁর যে 'কন্ট্র্যাক্ট' হয়ে আছে, তিনি আর তা 'পারসু' করবেন না । তাঁর সাদা ধবধবে মেঘমুক্ত শারদীয় আকাশের মতো মুখে যেন বেলাশেষের অস্তরাগের আলো পড়ে লাল হয়ে ফুটে উঠেছিল ক্ষোভ-অভিমান-যন্ত্রণা, স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম ।
আমি শুধু ভাবি, কবে মানুষ হব আমরা ? আমরা আর কবে মানুষ হব ? বৃদ্ধ বয়সে, রুগণ শরীরে, ব্যক্তিগত যন্ত্রণায় দীর্ণ যে মানুষটা মুখে অকৃত্রিম হাসির প্রলেপ এঁটে একটা জাতিকে সম্মৃদ্ধ করে গেলেন কয়েক যুগ ধরে, আমরা তাঁকেও আঘাত করতে ছাড়লাম না ! আমরা এমন বাঙালি ! মাঝে মাঝে মনে হয়, এই পোড়া বাংলায় নয়, এমন শিল্পী ইউরোপের কোনও দেশে জন্মালে, মানুষ হয়তো তাঁকে আরও অনেক কিছু দিতে পারতেন ! আমরা শুধু নিয়েই গেলাম, দিতে পারলাম না !

মঞ্চ থেকে তাঁর বাড়ির ভেতরঘর পর্যন্ত এই মানুষটার অবিরল অনাবিল প্রশ্রয় আর ভালবাসা আমার ইহজীবনের পরম প্রাপ্তি ! আজ তাঁর শুভ জন্মদিনে আমার হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা আর শ্রদ্ধা এই চিরজীবীকে...

(পুনশ্চ: সংবাদ প্রতিদিনের তদানীন্তন অনুলেখক আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় প্রিয়জন; আমি তাঁর অনুজ, স্নেহের পাত্র । তাঁকে কোনও রকমভাবে কালিমালিপ্ত করার অভিপ্রায় বা ঔদ্ধত্য কোনওটিই আমার নেই, কোনও দিন ছিলও না । )

















