top of page
Search

মহাশ্বেতা দেবী: ভালবাসার ডাক

(আজ ১৪ জানুয়ারি মহাশ্বেতা দেবীর জন্মদিন । এই অবসরে কিছু ফিরে দেখা, কিছু মনে পড়া ।)


ree

মহাশ্বেতা দেবীর বিপুল রচনাসম্ভারের বিপুলতর সামাজিক ও সাহিত্যিক মূল্য নির্ধারণের দীর্ঘ রচনা প্রস্তুতির অভিপ্রায় বা অবসর কোনওটিই এই মুহূর্তে আমার নেই; তার চেয়ে বরং, আজ ১৪ জানুয়ারি, তাঁর জন্মদিনে, আসুন, স্মৃতির গহনে খানিক অবগাহন করা যাক !


তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছি ! শান্তিনিকেতনের আদিগন্ত উন্মুক্ত প্রান্তর, উপচীয়মান আকাশ, বর্ষার প্রথম জলে ফুলে ওঠা আঁটোসাঁটো খোয়াই, উদ্ভিন্নযৌবনা ধানখেত, সুউচ্চ তাল-তমালের সারি, পলাশ-কৃষ্ণচূড়ার রক্তাভ উন্মেষ, শিশিরের শব্দ, শালের ফুল, আমের বোল, মুচুকুন্দুর গন্ধ--সব চুরমার করে বেঙ্গল অম্বুজা-বেঙ্গল পিয়ারলেসের আবাসন প্রকল্পগুলোর দ্বারা চার দিকে কংক্রিটের জঙ্গল নির্মাণ ও লাহাবাঁধে প্রমোদ উদ্যান স্থাপনের মাধ্যমে বিশ্বভারতী অ্যাক্ট-১৯৫১-কে যেভাবে পদদলিত করার চক্রান্ত চলছিল, আমরা সবেমাত্র তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের আগুন ধিকিধিকি জ্বালিয়ে তুলছিলাম ! সেই সময়ে আমাদের একজন বড় নেতার প্রয়োজন ছিল, আমরা পাগলের মতো একজন নেতা খুঁজছিলাম--এমন একজন নেতা যাঁর আন্তর্জাতিক, নিদেনপক্ষে সর্বভারতীয়, পরিচিতি আছে ! মহাশ্বেতাদি এলেন ! আমার পিঠ ছুঁয়ে বললেন, "তোমাকে আমি চিনি তো , দেশ পত্রিকায় কবিতা লেখো ! "


ree

বটবৃক্ষসম এক নেতাকে পেয়ে আমরা তীব্রতর করলাম আমাদের আন্দোলন, পৌঁছলাম রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত ! বাকিটুকু ইতিহাস !


শুধু শান্তিনিকেতনের পরিবেশই নয়, শান্তিনিকেতনের আদর্শ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রশাসন--সর্বত্র যে বিপন্নতার দাগ, যে কলঙ্কের ছাপ, যে অশনিসংকেত--তার বিরুদ্ধে এই অসমসাহসী মহিয়সী মহিলা যেভাবে তাঁর আজানুলম্বিত হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, শান্তিনিকেতনবাসী তাঁর সে-ঋণ কোনও দিন শোধ করতে পারবে না ! সকল কলহ-দলাদলি-স্বজনপোষণ ভুলে  হৃদয় সংবিত্তির দ্বারা পরিচালিত আদর্শ,সৎ, শিক্ষাব্রতী,রবীন্দ্রানুরাগী, ছাত্রদরদী মানুষকে শান্তিনিকেতনে মানুষ গড়ার কাজে নিয়োজিত করার আশু প্রয়োজনীয়তার কথা তাঁর মতো এত বলিষ্ঠ, এত মমতামাখা, এত অসহায় অথচ নিবিড় কণ্ঠস্বরে আর কাউকে উচ্চারণ করতে দেখিনি আমার সারা জীবনে !


ree

আর একটা স্মৃতি--২০০৪ সালের কথা ! আমার সম্পাদিত 'ভালোবাসা' সাহিত্যপত্রের বিশেষ বইমেলা সংখ্যা প্রকাশের কাজ চলছে, বিষয়--"প্রসঙ্গ: নারী" ! মহাশ্বেতাদির কাছে চাইলাম কোনও পুরনো লেখা নয়, একদম টাটকা একটি গল্প ! বলা বাহুল্য , উনি তখন ভয়ঙ্কর কর্মব্যস্ত লেখক, যাঁর কাছে কোনও সবুজপত্রের জন্য টাটকা একটি গল্প পাওয়া সোনার পাথরবাটির মতোই অলীক ! কিন্তু তিনি মহাশ্বেতা দেবী--যাঁর বুকের ভেতরে বহমান ভালবাসার ঝরনাধারা ! তিনি পত্রিকার নাম শুনে আপ্লুত হলেন, "আমি এই পত্রিকাটির নাম কখনও শুনিনি, কিন্তু এমনই  নামের মায়া তোমার কাগজের...তোমায় না করতে পারছি নে ! তবে সময় লাগবে , সময় দিতে হবে !"


ree

রেজিস্টার্ড পোস্টে মহাশ্বেতাদির গল্প এল ! কী আশ্চর্য--গল্পের নামও 'ভালবাসা'  ! পাগল উমদাবাইয়ের গল্প--দু'চোখ ভরে জল এসে যায় ! মহাশ্বেতা  দেবীর  'ভালবাসা' দিয়েই শুরু হল 'ভালোবাসা' পত্রিকার ২০০৪-এর বিশেষ বইমেলা সংখ্যার লেখামালা !


মহাশ্বেতাদির সঙ্গে নবনীতাদি (দেবসেন), শাঁওলীদি (মিত্র), দেবারতি মিত্র, নাহারদি (মিরাতুন নাহার), বিজয়া মুখোপাধ্যায় , দময়ন্তী বসু সিং, যশোধরাদি (রায়চৌধুরী)--এ রকম কয়েকজন নারী লেখকের লেখায় সম্মৃদ্ধ হয়ে 'ভালোবাসা'র নারী সংখ্যা হট কেকের মতো বিক্রি হল ২০০৪-এর  কলকাতা বইমেলায় ! এখনও মনে আছে 'কোরকে'র তাপসদা (ভৌমিক) শেষ পর্যন্ত জোগান দিতে পারেননি পত্রিকার, পাঠক ফিরে গিয়েছেন খালি হাতে ! সবুজপত্র যে বিক্রি হয় না, গরিব সম্পাদকদের এই ছিঁচকাঁদুনে মিথ্যেটা নিয়ে না হয় আরেক দিন লেখা যাবে কোথাও !


ree

এর পর থেকে বহুবার মহাশ্বেতাদির সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাঁর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যলাভে ধন্য হয়েছি, অজস্র চিঠি পেয়ে কৃতার্থ হয়েছি, তাঁর বাড়িতে তাঁর হাতে খেয়েছি, তাঁর স্নেহস্পর্শে আপ্লুত হয়েছি, তাঁর চরণস্পর্শে শিহরিত হয়েছি; কখনও  একবারটির জন্যেও এই বোধ জন্মায়নি--তিনি তাঁর ভালবাসার জলঝরনা  দিয়ে জন্মাতে দেননি--যে আমি, এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কলমচি, 'অফিসিয়ে দেজার এ দে লেতর'-এ ভূষিত এই বিশ্বজয়ী কথাশিল্পী, এই অসামান্য সমাজসেবীর পাশে বসারও যোগ্য ছিলাম না কোনও অর্থে !


 
 
 

Comments


bottom of page