top of page
Search

আজ ২৬/১১, একটি অমর প্রেমকথা

ree

স্যার দিনশ মানেকজি পেটিট-এর নাম বোধ করি অনেকেরই অজানা নয় । জন্ম ৩০ জুন, ১৮২৪, মৃত্যু ৫ মে, ১৯০১ । পরিচয় ? তিনি হলেন প্রথম ব্যারনেট, ব্যারন হল বৃটেনের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির একটি বিশেষ পদমর্যাদা--এই খেতাবধারী প্রথম ব্যক্তি ছিলেন তিনি । শুধু কি তাই, তিনি ছিলেন ভারতবর্ষে প্রথম কাপড়ের মিলের প্রতিষ্ঠাতা । আমেরিকায় যখন গৃহযুদ্ধ চলছে, ইউরোপে ব্যবসার সূত্রে তিনি বিশাল সম্পত্তির মালিক হন । আরও আছে । ১৮৫৪-তে দিনশ প্রতিষ্ঠা করলেন 'Persian Zoroastrian Amelioration Fund', ইরানের ভাগ্যবিড়ম্বিত Zoroastrian সন্ন্যাসীদের তদানীন্তন পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে । ১৮৮৬-তে হলেন গভর্নর জেনারেলের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য । কিন্তু এ সবের বাইরেও তাঁর আসল পরিচয় হল, তিনি ছিলেন দানবীর । মানবতাবাদী কাজে, আর্তের সেবায় তিনি তাঁর বিশাল সম্পত্তি বিলিয়ে দেন । মেয়েদের জন্য কলেজ, হাসপাতাল, পশু চিকিৎসালয় তৈরি--কী না করেছেন ! ১৮৮৭-তে হলেন নাইট, আর ব্যারনেট ১৮৯০-তে ।মানুষের সেবায় আত্মনিবেদনের জন্যই এই পার্সি মানুষটি ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন ।

এই মানুষটির নাতনি, মানে তাঁর পুত্র দ্বিতীয় ব্যারনেট স্যার দিনশ পেটিট-এর একমাত্র কন্যা রতনবাই পেটিট--যিনি লেডি রতি নামেই বেশি পরিচিত--ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, অসামান্য সুন্দরী এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের এক অতি বড় সমর্থক । মুম্বইয়ের অন্যতম ধনী ও সম্ভ্রান্ত পার্সি পরিবারের এই অপরূপা কন্যাটি 'দ্য ফ্লাওয়ার অব বোম্বাই' নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন । যাই হোক, তাঁর যখন মাত্র ১৬ বছর বয়স, ১৯১৬-র গ্রীষ্মে স্যার দিনশ-র বাড়িতে ভিন্নধর্মাবলম্বী, বিপত্নীক এক পিতৃবন্ধুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই মন দেওয়া-নেওয়া--যাকে বলে, একেবারে 'লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট' । প্রেমিক পুরুষটির বয়স তাঁর দ্বিগুণেরও বেশি । দূর অতীতে ১৮৯২-তে তাঁর প্রথম বিয়ে হয়ে গিয়েছে ! কিন্তু প্রেমে আর যুদ্ধে তো অন্যায় বলে কিছু নেই, তাই এ হেন মানুষটিই তখন ষোড়শী সুন্দরীর মন প্রাণ জুড়ে...!

হলে কী হবে, বাবা মানবেন নাকি ? স্যার দিনশ-র কাছে মেয়ের প্রেমিক পুরুষটি অন্যরকমভাবে পাড়লেন কথাটা, "আচ্ছা ইন্টার কমিউনাল ম্যারেজকে তুমি কী চোখে দ্যাখো?" উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত দিনশ বললেন, "বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির আবহ রচনা করতে এ তো উত্তম ব্যবস্থা !"

"তবে তোমার মেয়েকে আমার বউ করে দাও," সঙ্গে সঙ্গে বলে বসলেন বন্ধুটি । ব্যস, আর যায় কোথায় ! এম সি চাগলা, যিনি প্রেমিক পুরুষটির তৎকালীন সহকারী--পরবর্তী সময়ে বোম্বাই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি--স্মৃতিচারণায় বলেছেন, "দিনশ এই প্রস্তাবে স্তম্ভিত হয়ে যান, রাগে লাল হয়ে ওঠে তাঁর মুখ, এবং এই ধরনের অবাস্তব অসম্ভব কথা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করতে তিনি মানা করে দেন বন্ধুকে । মেয়েকেও জানিয়ে দেন, তাঁর বাড়িতে থাকতে হলে, জীবনে ওই ব্যক্তির মুখদর্শন করা চলবে না ।"


ree

কিন্তু প্রেমে আর নিষেধ মানে ক'জন ? মানেননি রতিও । গোপনে দেখা-সাক্ষাৎ, মেলামেশা চলতেই থাকে দু'জনের । কিন্তু মেয়ে তো নাবালিকা ! ১৮ না হলে বিয়েটা হবে কী করে ? সময় থেমে থাকে না । ১৮ পূর্ণ হল সুন্দরীর । সেটা ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৮ । অভিজাত তাজমহল হোটেলে ঘটা করে জন্মদিন পালন হল তাঁর । এর ঠিক দু'মাস পরেই ১৯ এপ্রিল ১৯১৮ দু'জনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন । রতি ধর্মান্তরিত হয়ে নাম নিলেন মরিয়ম; মাহমুদাবাদের রাজা উপহার দিলেন বিয়ের আংটি; পাত্রপক্ষের সামান্য কিছু নিকট বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্যে বিয়ের কাজকর্ম সম্পন্ন হল বোম্বাইয়ে পাত্রের নিজের বাড়িতে । নৈনিতালের মাহমুদাবাদ রাজপ্রাসাদে আর দিল্লিতে লালকেল্লার অনতিদূরে মেডেন্স হোটেলে নবদম্পতি হানিমুন সারলেন শেষমেশ । পার্সি সম্প্রদায় এই বিয়ে মেনে নেয়নি ।

তাজা ফুলের সুবাস আর মহার্ঘ রত্নখচিত ফিতেয় বিনুনি করা দীর্ঘ প্রলম্বিত চুলের এই অনন্যা সুন্দরীর পাশে তাঁর সুদেহী সুদর্শন অভিজাত স্বামীটি ! শুরু হল প্রেমের দ্বিতীয় অধ্যায়, সুখের ঘরকন্না । জন্মাল একটি মেয়েও--দিনা। কিন্তু সুখ স্থায়ী হল কই ? স্বামীটি এমন কাজের মানুষ যে, স্ত্রীকে সময় দেওয়াই তার পক্ষে একান্ত অসম্ভব হয়ে পড়ল । দীর্ঘ, দীর্ঘতর সময় তাঁকে ব্যয় করতে হত কাজের সূত্রে দেশ-বিদেশে ঘুরে । মরিয়ম ক্রমেই একান্ত নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন । একাকিত্ব যখন তাঁকে ভয়ঙ্করভাবে গ্রাস করতে লেগেছে, তখনই ১৯২২-এর সেপ্টেম্বরে মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন লন্ডনে । দেশে ফিরে স্বামীর সঙ্গে সময় কাটানোর ফের চেষ্টা করে দেখলেন, কিন্তু না, পাওয়া গেল না তাঁকে । তিনি তখন পাগলের মতো ব্যস্ত । মরিয়ম আস্তে আস্তে আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকতে লাগলেন, চেষ্টা করলেন স্বামীকেও সে দিকে টানার । কিন্তু কোথায় কী ! ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় পাঁচ মাসের জন্য তাঁর কাজের ডাক এল । ১৯২৭ থেকে মরিয়ম স্বামীর থেকে আলাদা থাকতে শুরু করলেন । তাঁর শরীর ভেঙে পড়তে লাগল দ্রুত । তাজ হোটেলের রুদ্ধদ্বার ঘরে তিনি নির্জনবাসী হয়ে রইলেন ভগ্ন শরীরে । তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন বন্ধু কাঞ্জি । মৃত্যুর দু'দিন আগে এই বন্ধুকেই তিনি শেষ অনুরোধ করে যান তাঁর পোষা আদরের বেড়ালের দেখাশোনার জন্য । ফেব্রুয়ারি ২০, ১৯২৯, ত্রিশতম জন্মদিনে, অবশেষে, পৃথিবীর মায়া শেষ । ফুরিয়ে গেল একটি ফুলের মতো জীবন ।


ree

এর দু'দিন পর, ২২ ফেব্রুয়ারি, অধুনা মুম্বইয়ের মাঝগাঁওয়ে Khoja Isan Ashari Cemetery-তে মুসলিম রীতি মেনে তাঁকে সমাধিস্থ করা হল । তাঁর কঠোরহৃদয় বাবা সেখানেও মেয়েকে বয়কট করেছিলেন । আর স্বামী ? তিনি পাথরের মতো বসে ছিলেন সামনে । শেষে যখন তাঁকে প্রথা মতো কবরে মাটি ছুড়ে দিতে বলা হয়, তিনি আর সামলাতে পারেননি নিজেকে--শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন ! চাগলা, তাঁর বিশেষ বন্ধু, স্মৃতিচারণ করেছেন এইভাবে--"মানুষিক কোনও দুর্বলতার কাছে সেই একবারই জীবনে তাকে ভেঙে পড়তে দেখেছিলাম । ...ভাগ্যের আশ্চর্য লিখন যে, যে প্রেমোপাখ্যান রূপকথার গল্পের মতো শুরু হয়েছিল একদিন, তার শেষটা এতই মর্মান্তিক যে, তা যে কোনও সেক্সপিয়রের ট্রাজেডির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে অনায়াসে ।"

১৯২৮-এর অক্টোবর মাসের ৫ তারিখে ফ্রান্সের মার্সেই থেকে স্বামীকে লেখা সম্ভবত শেষ চিঠিতে রতি তাঁর ভালবাসা আর বঞ্চনার মর্মস্পর্শী হিসেবনিকেশ করে গিয়েছেন এইভাবে--"...প্রিয়, জীবনে আমি এত বেশি কষ্ট পেয়েছি কেন জানো ? কারণ আমি অনেক বেশি ভালবেসেছি তোমাকে । আমার যন্ত্রণার পরিমাণ আমার ভালবাসার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ । যে ফুলকে একদিন তুমি তুলেছিলে নিজে হাতে, তার মধ্যে আমাকে মনে রাখার চেষ্টা কোরো, যে ফুলকে দিনের পর দিন পদদলিত করে গেছ, তার মধ্যে নয় ।"

পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছেন চিরবিরহিনী এই অবিস্মরণীয় প্রেমিকার স্বামীপুরুষটি কে ! হ্যাঁ, এই অমর প্রেম কাহিনির নায়ক কিংবদন্তি রাজনৈতিক নেতা তথা পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্রষ্টা মহম্মদ আলি জিন্না । ২০০৮-এর ২৬/১১ বিস্ফোরণে যে-তাজমহল দাউদাউ জ্বালিয়ে দিয়েছিল কাসভ ও তার সঙ্গীরা, সেই তাজমহলেই একদিন কত মধুর সময় কাটিয়েছিলেন কাসভেরই দেশের জন্মদাতা ও তার রূপসী অর্ধাঙ্গিনী ! সেই তাজমহলেরই রন্ধ্রে রন্ধ্রে লেগে ছিল রতনবাইয়ের উনিশতম জন্মদিন পালনের অমোচনীয় স্মৃতিচিহ্নগুলি । কাসভ মামলার রায় দিতে গিয়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মাননীয় আফতাব আলম ও মাননীয় সি কে প্রসাদের ডিভিশন বেঞ্চও এই প্রেম কাহিনির কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি, "ভাবতে অবাক লাগে, কয়েদ-ই-আজম জিন্না কি কখনও ভেবেছিলেন তাঁরই তৈরি দেশের এক নাগরিক তাঁর অন্যতম পছন্দের শহরের অতি পরিচিত ওই তাজ হোটেলে এমন মর্মান্তিক আঘাত হানবে ?" এমনকী মাঝগাঁওয়ে, যেখানে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন তাঁর হৃদয়বল্লভি, কাসভেরা সেখানেই ঘটিয়েছিল গাড়িবোমা বিস্ফোরণ !

সে দিনের গাড়িবোমা বিস্ফোরণে লেডি রতির আত্মা কেঁপে উঠেছিল কি না, কিংবা ওই রক্তাক্ত সন্ত্রাসবাদী হানায় জিন্নার আত্মা কতখানি অতৃপ্ত হয়েছিল, সে অধ্যাত্মবাদের প্রশ্ন; কিন্তু একটি ঘৃণ্য নৃশংস সন্ত্রাসবাদী হানার পনেরো বছর পূর্তিতে ওই অমর প্রেমোপাখ্যানের স্মৃতিচিহ্নগুলি পাকিস্তান তথা সারা বিশ্বের সমস্ত নাগরিকের হৃদয়ে ২৬/১১ হত্যালীলার নৃশংসতাকে নিপুণভাবে জীবন্ত করে তুলে আরও 'বেঁধে বেঁধে থেকে' সন্ত্রাসমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার বার্তা পৌঁছে দিক, সর্বমঙ্গলময়ের কাছে আজ এ-আকুল প্রার্থনাটুকুই হোক সেই নারকীয় প্রলয় কাণ্ডের সারাৎসার, আমাদের স্বপ্ন দেখার সম্বল ।


 
 
 

Comments


bottom of page