top of page
Search

স্বাধীনতা দিবস মানে কি শুধুই একটা ১৫ অগস্টের সকাল ?

(আজ ১৫ অগস্ট । স্বাধীনতা দিবস । দিকে দিকে উৎসব । উদযাপন । কিন্তু সত্যিই কি আমরা স্বাধীন হয়েছি ?)


ree

"যদি তুমি ফসল ফলাতে না জানো

যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও

তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি ।

যে মানুষ গান গাইতে জানে না

যখন প্রলয় আসে, সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায় ।

তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে;

তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায় ।"

( বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘বেঁচে থাকার কবিতা’ )


কবির এই উচ্চারণ আজকের সকালে বড় বেশি করে প্রাসঙ্গিক ও যুক্তিযুক্ত মনে হয় । স্বাধীনতা দিবস মানে কি শুধু একটা ১৫ অগস্টের সকাল ? স্বাধীনতা দিবস মানে কি দেশের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য, বিদেশি শাসকের হাত থেকে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল উন্মোচনের জন্য যে সমস্ত দেশনায়ক জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হাসিমুখে জীবনোৎসর্গ করেছিলেন, সেই সব বীর সেনানীর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান শুধু ? এই কি তাঁদের প্রতি, তাঁদের অভীপ্সার প্রতি, তাঁদের আত্মত্যাগের প্রতি, এবং সর্বোপরি, আমাদের অর্জিত স্বাধীনতার প্রতি প্রকৃত ও যথার্থ ন্যায়বিচার ?


ree

না । স্বাধীনতা দিবস মানে, আরও বেশি কিছু । স্বাধীনতা দিবস মানে, একটা শপথ গ্রহণের দিন । স্বাধীনতা দিবস মানে, একটা সংকল্প, একটা অঙ্গীকার করার দিন । স্বাধীনতা দিবস মানে, "তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে ।" স্বাধীনতা দিবস মানে, "তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়" । হ্যাঁ, সে বলতে চায়—দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চায়—ভারতবর্ষ আজও স্বাধীন হয়নি, আমরা এখনও পরাধীন । এই পরাধীনতা শোষণ ও বঞ্চনার, এই পরাধীনতা দুর্নীতি আর কালোবাজারির, এই পরাধীনতা অন্যায় ও অবিচারের, এই পরাধীনতা অশিক্ষা ও অন্ধকারের, এই পরাধীনতা দারিদ্র ও অপুষ্টির, এই পরাধীনতা অসাম্য ও সাম্রাজ্যবাদের, এই পরাধীনতা এ দেশের মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার, জীবনযন্ত্রণায় দগ্ধে যাওয়ার । স্বাধীনতার এত বছর পরেও, দেশের মেয়েদের নিরাপত্তা তলানিতে । ফতোয়া জারি । সালিশি সভা । চুল কেটে ঘোরানো । নিগ্রহ । দীর্ঘ সময় ধরে সেই নিগ্রহের ছবি তুলে দানবীয় উল্লাস । ধর্ষণ । খুন । এ শুধু প্রান্তিক অশিক্ষিত মেয়েদের ওপরেই নয়, সমাজের উচ্চশিক্ষিত ওপরতলার মেয়েদের ওপরেও সুযোগ পেলেই এই অত্যাচার, এই অসম্মান সমান তালে চলছে । উদাহরণ দিয়ে বিষয়কে মহাভারত বানিয়ে তোলা অর্থহীন ও অযৌক্তিক । পাঠক তাঁর নিজের পরিপার্শ্ব থেকেই উদাহরণ সংগ্রহ করে নেবেন । নারীর প্রতি পুরুষের বিকৃত অসুস্থ কামনার আগুনে দাউদাউ জ্বলছে স্বাধীনতা । জ্বলছে আমাদের তেরঙা পতাকার অন্তর আত্মা ।


ree

কালো টাকায় দেশ ভরে আছে । নেতা-মন্ত্রীদের কোটি কোটি টাকার অর্থনৈতিক দুর্নীতি আর কেলেঙ্কারিতে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে মুখ দেখানো লজ্জার । বিপন্ন দেশের অর্থনীতি । অথচ কেলেঙ্কারিতে জড়িত তথাকথিত উচ্চশ্রেণির মানুষ বিপুল ক্ষমতা আর অর্থের জোরে অন্ধকার থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে এসে আবার রচনা করছে নতুন কেলেঙ্কারির বুনোট । বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে ! তাদের অপকীর্তির ফলে নষ্ট হচ্ছে অর্থনৈতিক ভারসাম্য । মুদ্রাস্ফীতি । বাজারে আগুন । মুখ থুবড়ে পড়ছে গরিব মানুষ । দিনগুজরান করতে হিমশিম খাচ্ছে । অপুষ্টি । অনাহার ।


ree

অকালমৃত্যু । যে সমাজে শিশুরা খেতে পায় না পেট ভরে, অপুষ্ট শীর্ণ দেহে একমুঠো ভাতের জন্য লাঠি ঝাঁটা খেয়ে কাজ করতে হয় মিষ্টির দোকানে কিংবা বড়লোকের বাড়িতে, সেই সমাজে স্বাধীনতা ঢুকবে কী করে ? ফলত শোষণ, বঞ্চনা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ... পক্ষাঘাতগ্রস্ত একটা সমাজ । ভোটের জন্য মদ দিয়ে কিনে নেওয়া হয় এদের, ভোট পেরোলে ক্ষমতায় আসা দল আর ফিরেও তাকায় না এ দিকে ।


ree

পণের জন্য গৃহবধূ খুন কিংবা ধর্ষণের জমজমাট খবর নেই, দূর অতীতেও এমন কোনও সংবাদপত্র পড়েছি বলে মনে করতে পারি না । আজও সংবাদপত্রে দেখি, ‘দুষ্কৃতীদের প্রহারে নিহত প্রতিবাদী যুবক ।’ দুষ্কৃতীদের জুলুমের প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ দেওয়া—তা সে পুলিশ কনস্টেবলই দিক বা স্কুল শিক্ষক—এখন এ-দেশের নিত্যনৈমিত্তিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে । প্রতিবাদী হওয়া চলবে না, মুখ বুজে মেনে নিতে হবে । এরই নাম স্বাধীনতা ? আজকের খবরের কাগজের ঘটনাগুলো ঘটেছে গতকাল, মানে ১৪ অগস্ট । আমি নিশ্চিত, ১৬ অগস্ট যদি খবরের কাগজ বেরোত, সৌভাগ্যবশত তা হয় না এ দেশে, তা হলে সে দিনও ‘ছাত্রের হাতে শিক্ষক নিগৃহীত’ কিংবা ‘বধূহত্যায় অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারের জেল হাজত’ জাতীয় খবর মোটা মোটা অক্ষরে লেখা থাকত পাতায় পাতায় । ছাত্রসমাজই স্বাধীন ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ আর পুলিশের হাতেই তো নাগরিক জীবনের স্বাধীনতা রক্ষার ভার ! ১৬ অগস্টের খবরের কাগজের এই দুটি সংবাদ ১৫ অগস্টে ঘটে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীর পতাকা উত্তোলন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক আনুষ্ঠানিকতার পাশে জাতির জন্য পরিবেশিত অনুপম উপহারের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারত । কিন্তু ১৬ অগস্ট তো কাগজ বেরোয় না, তাই ওই উপহারটি পেতে আমাদের আরও ২৪ ঘণ্টা, মানে ১৭ অগস্টের সকাল অবধি অপেক্ষা করতে হয় ।


ree

এই আমাদের স্বাধীনতা । তাই বক্স বাজিয়ে শ’খানেক দেশাত্মবোধক গানের সুরে গুনগুন করে সময় কাটানোর দিন এই ১৫ অগস্টের সকাল নয় । স্বাধীনতার জন্য আমাদের এখনও অনেক যুদ্ধ বাকি । দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের দামামা তো আমাদেরই বাজাতে হবে । সেই যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় এই ১৫ অগস্টের সকাল । সেই যুদ্ধের শপথ নেওয়ার সময়, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংকল্প গ্রহণের সময়, এই ১৫ অগস্টের সকাল । অন্যায়-অবিচার-শোষণ-প্রবঞ্চনা-দারিদ্র-দুর্ভিক্ষ-অশিক্ষা-জাতপাত-দুর্নীতি-কালোবাজারি-ব্যভিচার-ইজ্জতহানি-অগণতন্ত্র ও সমস্ত রকম অনাচারের হাত থেকে দেশকে প্রকৃত স্বাধীন করার এই সংকল্প তথা অঙ্গীকারের মধ্যেই দেশের জন্য প্রাণ বলিদান দেওয়া মহান দেশনায়কদের প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধার্ঘ নিহিত থাকবে মনে হয় । যে মানুষ গান গাইতে জানে না, যখন প্রলয় আসে সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায় । তাই প্রলয় আসার আগেই গান-না-জানা প্রান্তিক ভারতবর্ষের মা মাটি মানুষকে এমন গান শেখাতে হবে, যাতে প্রলয় এলে, সে বোবা আর অন্ধ না হয়ে, ঝড়ঝাপটার উপযুক্ত মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে । ১৫ অগস্টের সকাল মানে তাই প্রকৃতার্থেই "তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে । তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায় ।"


(ছবিঋণ : কেরিয়ার পাওয়ার ।)


(লেখাটি ২০১৮ সালের ১৫ অগস্টের আনন্দবাজর পত্রিকায় প্রকাশিত ।)




 
 
 

Comments


bottom of page