সুনীলদাকে নিয়ে লেখা আর আমার হল না...
- rajatsubhrablog
- Sep 7, 2023
- 6 min read
(আজ ৭ সেপ্টেম্বর । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন । স্মৃতির অলিন্দ থেকে ধুলো ঝেড়ে জেগে ওঠে হিরন্ময় কিছু ছবি ।)

সুনীলদাকে নিয়ে লিখব বলে যতবারই খাতা কিংবা নোটপ্যাড খুলে বসেছি, কী লিখব আর ভেবে উঠতে পারিনি শেষ পর্যন্ত । কারণ, তাঁকে নিয়ে লেখার তো কিছু অবশিষ্ট নেই । সবাই সব কিছু লিখে ফেলেছেন তাঁকে নিয়ে । আমি, এই ক্ষুদ্র কলমচি, আর নতুন কথা কী লিখব ? ফলে যা-ই লিখি তা পাঠকের কাছে স্রেফ পুরোনো লেখারই চর্বিতচর্বণ ছাড়া আর কিছু মনে হবে না ।
তিনি দেশবিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, সম্পাদক ছিলেন, এ কথা কে না জানেন ? কে না লিখেছেন ? আমরা যারা 'পূর্ব-পশ্চিম' পড়ে বড় হয়েছি, 'প্রথম আলো', 'সেই সময়' পড়েছি; 'অরণ্যের দিনরাত্রি', 'মনের মানুষ' কিংবা 'প্রতিদ্বন্দ্বী' দেখেছি, অবশ্য 'অরণ্যের দিনরাত্রি'র চিত্ররূপ তাঁর পছন্দ হয়নি খুব একটা; কিম্বা তাঁর নীরাকে পেয়েছি আপন করে, তার রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শে ঋদ্ধ হয়েছি, অবশ্য একবার এক প্রথম শ্রেণির পত্রিকা নীরার যে ফোটোগ্রাফিক অবয়ব ছাপিয়ে স্বয়ং তার সৃষ্টিকর্তা সমেত অসংখ্য গুণমুগ্ধ শিল্পরসিকদের বিরাগভাজন হয়েছিল, সে রূপের কথা বলছি না; পেয়েছি পুনর্জন্ম পাওয়া 'কৃত্তিবাস'কে, আগের 'কৃত্তিবাসে'র সময়ে, বলা বাহুল্য, আমাদের জন্মই হয়নি, তবুও সে-ইতিহাসও তো জেনেছি লোকমুখে কিংবা বই পড়ে, বাংলা কবিতায় অত বড় আন্দোলন--হ্যাঁ, আন্দোলনই তো--আর কখনও হয়েছে নাকি; সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর দিগন্তবিস্তৃত ব্যাপ্তি নিয়ে, তাঁর অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে, সত্যি বলতে কী, কোনও প্রশ্নই থাকতে পারে না ! আর প্রশ্নই যখন থাকতে পারে না, তাঁকে নিয়ে যা-ই লিখব তা আমার পূর্বসূরীদের প্রশস্তিরই অক্ষম অনুকরণ ভিন্ন আর কিছু হয়ে উঠবে না ! সুতরাং তাঁর খ্যাতি নিয়ে, তাঁর ব্যাপ্তি নিয়ে আমার আর কিছু লেখা হল না !

তবে কী লিখব ? তিনি কেমন ধারার মানুষ ছিলেন ? কত বড় মন ছিল তাঁর ? এ-ই বা নতুন কথা কী ? তিনি তো কাউকেই ফেরাতেন না, সকলের মনস্কামনা তিনি পূর্ণ করতেন । এ রকমই তো আমার পূর্বসূরীরা লিখেছেন, উত্তরসূরীরা লিখছেন । জনপ্রিয় দৈনিক থেকে শীর্ণ সবুজপত্র--তাঁর স্মরণে বরণে ক্লান্তিহীনভাবে নামিয়েছে 'সুনীল আকাশ' কিংবা 'সুনীল সাগর' জাতীয় লেখামালা । অর্থাৎ মানুষ হিসেবে 'আকাশ' কিংবা 'সাগরে'র মতোই ছিল তাঁর ব্যাপ্তি ! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়কে খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হেতু, আমার ব্যক্তিগত অভিমতও ওই একই--অর্থাৎ, ব্যক্তিগতভাবে আমারও তাঁকে খুব বড় মনের মানুষ বলেই মনে হয়েছে ।
সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের জন্য, অথবা অন্য কোনও কারণ আছে কি না আমার জানা নেই, একজন-দু'জন অবশ্য তাঁকে খুব খারাপ মানুষ বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন এক সময়ে । এমনই একজন সাহিত্যিকের যুক্তি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নাকি তাঁর আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্তির বিরোধিতা করেছিলেন ! কী হাস্যকর ! তদানীন্তন আনন্দ পুরস্কার কমিটির একজন সম্মাননীয় সদস্য তিনি, সুতরাং তিনি বিরোধিতা করতেই পারেন, এটা তাঁর আইনসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত অধিকারের মধ্যে পড়ে ! প্রসঙ্গক্রমে বলি, এই কলমচি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত হলেও, এবং পর পর তিনবার 'কৃত্তিবাস পুরস্কারে'র জন্য মনোনীত হলেও, তিনি কিন্তু ওই পুরস্কার পাননি ! এবং আমি খুব ভাল করে জানি, ওই পুরস্কার কমিটির কে বা কারা কবে, কোথায়, কীভাবে এবং কেন আমার পুরস্কার পাওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন ! কই আমি তো কোথাও মুখ খুলিনি ! খুলিনি কারণ, আমি জানি, এই বিরোধিতার অধিকার তাঁদের ছিল ! সুনীল বিরোধী জনপ্রিয় ওই কথাসাহিত্যিক আরও বলেছিলেন, তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্তির পর সুনীলবাবু যখন শুনেছিলেন যে, তিনিই নাকি তাঁকে ওই পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছেন, তখনও সুনীলবাবু তার বিরোধিতা করেননি । আরও হাস্যকর ! কেন বিরোধিতা করতে যাবেন ? আমার তো মনে হয়, এক্ষেত্রেও নীতিসঙ্গত দায়বদ্ধতাই পালন করেছেন তিনি--গোপনীয়তা রক্ষার দায়বদ্ধতা ! আসলে কিছু মানুষ অন্যের চরিত্রহননে অপার আনন্দ লাভ করেন ! যাঁরা আনন্দ লাভ করেন, তাঁরা পছন্দের কাজ করে যান, সুনীলদাই চরণ উদ্ধৃত করে আমি শুধু বলি, "চাঁদের গায়ে লাগলো ধুলো,/ কে যে কার সঙ্গে শুলো,/ আমার কিছু যায় আসে না !"
তা হলে বাকি রইল কী ? "তিন জোড়া লাথির ঘায়ে পাপোশে লুটোয় রবীন্দ্র রচনাবলি" ? তাঁর রবীন্দ্র কবিতাকে অস্বীকার করার কথা ? না না, অস্বীকার তো শেষ অবধি তিনি করেননি, বা, প্রাথমিকভাবে করলেও, তিনি তো পুনরাআবিষ্কার করেছেন ! সেই অস্বীকার ও পুনরাবিষ্কারও তো আমরা সকলেই জানি ! রবীন্দ্র রচনাবলির পাপোশে লুটোনোর ব্যাখ্যাও তো বহুল প্রচলিত দৈনিকে শঙ্খ ঘোষ ব্যক্ত করে দিয়েছিলেন খুব স্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে ! আমরা সকলেই পড়ে নিয়েছি, পড়ে ঋদ্ধ হয়েছি সে বিশ্লেষণ । রবীন্দ্রসৃষ্টি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে তাই শেষ অবধি অন্য কবি-শিল্পীদের মতোই প্রাণিত করেছিল, কোনও সন্দেহ নেই । যৌবনের ভুল তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন অকুণ্ঠ চিত্তে । সেইসঙ্গে এ কথাও তো সত্যি, রবীন্দ্রপূজায় তিনি কোনও দিনই বিশ্বাসী ছিলেন না । রবীন্দ্রমননকে নব নব আঙ্গিকে আবিষ্কারের মধ্যেই নিহিত ছিল তাঁর যাবতীয় রবীন্দ্রচর্চা । এ বিষয়ে তিনি আমাদের বারবার উৎসাহিতও করেছেন । রবীন্দ্র জন্ম সার্ধশতবর্ষে কৃত্তিবাস ও ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের যৌথ উদ্যোগে কলকাতার আইসিসিআর সত্যজিৎ রায় অডিটোরিয়ামে যে 'রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত এক সন্ধ্যা'র আয়োজন করেছিলেন তিনি, সেখানে আমন্ত্রিত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে এই তরুণতর কলমচি পর্যন্ত সকলের কাছেই তাঁর নির্দেশ ছিল, রবীন্দ্রপূজা নয়, তাঁকে, তাঁর সৃষ্টিকে, নতুন নতুন করে বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেই সন্ধ্যাকে সমৃদ্ধতর করে তুলতে । আমরা আমাদের সাধ্যমতো কেউ কবিতায়, কেউ গদ্যে, সেই সন্ধেয় রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছিলাম । মনে আছে, বিজয়াদি, মানে বিজয়া মুখোপাধ্যায়, মৃত্যুপথযাত্রী মৃণালিনী দেবীর শমীকে দেখতে চাওয়ার শেষ অনুরোধ না-রেখে শয্যাপাশে রথীকে হাজির করানোর কৌশলী রাবীন্দ্রিক আয়োজনের তীব্র সমালোচনা করে সরাসরি রবীন্দ্রনাথকে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন ! অবিস্মরণীয় সেই সন্ধের সমস্ত কাজটি ধরা আছে দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমে; কবির পরিকল্পনা ছিল, ২০১৩-র কলকাতা পুস্তক মেলায় সমগ্র কাজটির একটি সিডি প্রকাশ করা । 'কৃত্তিবাসে'র দপ্তরে কাজটি সম্পূর্ণ হয়ে পড়েও ছিল, আমি জানি । সম্ভবত সম্পাদকের প্রয়াণে তা আর পৃথিবীর আলো দেখেনি ! পরবর্তীতে তো 'কৃত্তিবাস'ই উঠে গেল ।

আর কী লিখব ? আমার সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অজস্রবার লিখেছেন সে কথা ? এও কি নতুন কিছু ? 'ভালোবাসা'র পাঠকমাত্রেই জানেন, 'ভালোবাসা'র পাতা বারবার সম্মৃদ্ধ হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় । লেখা চাইতে গেলে কখনও বিমুখ করতেন না তিনি । কখনও ডাকে, কখনও হাতে হাতে লেখা দিয়ে সেই চিরনির্লিপ্ত কণ্ঠে বলেছেন, "প্রুফটা নিজে দেখে দিয়ো, রজত ।"

তবে শেষবার তাঁর কাছে লেখা চাইবার অভিজ্ঞতা বড় সুখকর নয়, কিছুটা বা অপরাধবোধে ভারী হয়ে আছে । বীরভূমের একটি সাহিত্য পত্রিকা আমাকে তাদের একটি বিশেষ কবিতা সংখ্যা নির্মাণের আমন্ত্রণ জানালে, প্রথমটাই অসম্মত হলেও, অগ্রজ সেই সম্পাদকের অনুরোধেই, শেষমেশ আমন্ত্রিত সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করি । এরপর সুনীলদার কাছে লেখা চাইতে গেলে তিনি 'ভালোবাসা' নামের একটি কবিতা আমার হাতে দিয়ে, মুখ তুলে সেই ভুবনভোলানো হাসি হেসে বললেন, "তোমার কাগজের নামেই এই কবিতা ।" মুহূর্তখানেক স্তব্ধ হয়ে রইলাম, তারপর আকস্মিক বিপন্নতা কাটিয়ে, নিজেকে কিছুটা সামলে, অনেক কষ্টে, কিছুটা বা অসহায়ের মতো, বললাম, "আমার কাগজটা আপাতত বন্ধ আছে দাদা । আমি...মানে...আমি এটা...মানে...অন্য একটা কাগজের জন্য..."
"কী নাম ? কোথা থেকে বেরোয় ?" তিনি গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন । কোনও নতুন কাগজের জন্য লেখা চাইতে গেলে ন্যূনতম সৌজন্য হল, সেই কাগজের একটি পুরনো সংখ্যা লেখককে দেখানো । তারপর লেখক সন্তুষ্ট হয়ে লেখা দিলে, সে লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর, কাগজের একটি কপি যত দ্রুত সম্ভব লেখককে পৌঁছে দেওয়া সম্পাদকের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য । বীরভূমের ওই সাহিত্য পত্রিকাটি সে সময়ে যদিও ১৬-১৭ বছরের পুরনো বলে দাবি করত, যাঁর কাছে লেখা চাইতে গেছি, তাঁর কাছে তো নতুন ! এ পত্রিকার নামও তিনি শোনেননি কস্মিনকালে । যাই হোক, আমার কাছে কোনও পুরনো সংখ্যা না থাকায়, কোনও কপি আমি তাঁকে দিতে পারিনি; এবং, নীতিগত কারণেই, 'ভালোবাসা' নাম্নী কবিতাটি তৎক্ষণাৎ তাঁকে আমি ফেরত দিয়ে দিই, যদিও তিনি ফেরত নিতে চাননি ।
এই ঘটনার ৫-৭ দিন পর ধনঞ্জয়দা, তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী, আমায় ফোন করে জানতে চাইলেন, সুনীলদা আমাকে যে লেখাটি কুরিয়ারের মাধ্যমে ধনঞ্জয়দাকে পাঠাতে দিয়েছিলেন, তা আমি ঠিকঠাক পেয়েছি কি না ! মুহূর্তের বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই, বাড়িতে বেল বেজেছে কুরিয়ার সার্ভিসের । হাতে পেয়েছি তাঁর একটি অন্য ধরনের হালকা রসের পদ্য--'উলটোপালটা' । সে কবিতা যথারীতি চলে যায় পত্রিকা দপ্তরে । ছাপা হয় । পত্রিকার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয় বীরভূম জেলা পরিষদের এসি হলে । কিন্তু, কী আশ্চর্য, পত্রিকার কপি পৌঁছয় না বেশিরভাগ লেখকের কাছেই ! সেই ভাগ্যবিড়ম্বিত লেখককূলের, ভাবলে অবাক লাগে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও একজন ! পত্রিকাটির কর্ণধারের কাছে বারবার এ ব্যাপারে দরবার করেও, বলা বাহুল্য, এই কাজ-ফুরোলে-পাজি কার্যনির্বাহী সম্পাদক বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি ।
ইতিমধ্যে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে কবিতা পাঠের জন্য আমন্ত্রিত হয়ে, সেখানে অগ্রজ কবিবন্ধু জামালদা (সৈয়দ কওসর জামাল, তদানীন্তন ভারপ্রাপ্ত অধিকর্তা, আকাশবাণী)-র কাছেও একই অভিযোগ পেয়ে, মনটা বিষণ্ন হয়ে ওঠে । প্রসঙ্গত, তিনিও এই কার্যনির্বাহী সম্পাদকের আমন্ত্রণে ওই পত্রিকার ওই সংখ্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ লিখেছিলেন--বিষয়, 'পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাংলা কবিতা' । বাড়ি ফিরেই আমার পাওয়া এক এবং একমাত্র কপিটি জামালদাকে কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিই । একখানা কবিতা লেখার সূত্রে ওই পত্রিকার একটি মাত্র কপিই আমি পেয়েছিলাম, সম্পাদনা কাজের জন্য, বলা বাহুল্য, কোনও অতিরিক্ত কপি, কোনও পারিশ্রমিক, এমনকী, কার্যকরী সম্পাদনার মুদ্রিত স্বীকৃতিটুকুও জোটেনি আমার । আজ এত বছর পরে সে জন্য অবশ্য আমার কোনও ক্ষোভ, দুঃখ বা অভিমান নেই । কিন্তু জামালদাকে আমার কপিটি পাঠাবার সময়ে একবারও কেন আমার মনে হল না--এখানেই আমার যন্ত্রণা--আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অবিসংবাদী সম্রাটও আমার মতো একজন অতি ক্ষুদ্র সম্পাদকের কাছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি আঞ্চলিক সাহিত্যপত্রের একটি বিশেষ সংখ্যা কখনও কোনও দিন চাইতে পারেন ? হ্যাঁ, চাইতেই পারেন--তাঁর অধিকার--কারণ তিনি সেখানে লিখেছেন । এবং সত্যি সত্যিই চেয়েওছিলেন ! কিন্তু পারিনি, আমি পারিনি তাঁর প্রাপ্য অধিকারটুকু হাতে তুলে দিতে । জামালদা বলেছিলেন, "তুমি আমার কপিটা ফেরত নিয়ে যেয়ো, আমি প্রতিলিপি বানিয়ে নেব ।" কিন্তু সে সময় আমি আর পাইনি । সে সুযোগ আমাকে আর দেননি সুনীলদা । আমাকে অপরাধী করে তিনি চলে গেছেন, অনেক দূরে চলে গেছেন, সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার, সমস্ত হিসেব-নিকেশের ঊর্ধে ।

চোখ বুজলে আজও দেখতে পাই, স্পষ্ট দেখতে পাই, দিল্লিতে সাহিত্য অকাদেমির অফিসে নিজের চেয়ারে সম্রাটের মতো বসে আছেন তিনি, আমরা সারা দেশের আমন্ত্রিত তরুণ লেখকেরা তাঁকে গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি; আমরা তরুণ-অনতিতরুণ কবিরা কবিতাপাঠ করছি 'কৃত্তিবাসে'র মঞ্চে, তিনি দর্শকাসন থেকে স্নেহাতুর চোখে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে; তাঁর কালো কুচকুচে হোন্ডা সিটিতে সামনের সিটে বসে আছি, পেছন থেকে সুনীলদা-স্বাতীদি ড্রাইভারকে বলছেন, "একটু এগিয়ে রজতকে নামিয়ে দিতে হবে, ও গীতাঞ্জলিতে নেমে যাবে"; তাঁর ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সে স্তূপীকৃত বই ঘেঁটে তাঁকে ক্রমাগত বিরক্ত করছি, স্বাতীদি স্ন্যাকস পাঠিয়ে দিচ্ছেন মমতা দিয়ে মেখে; তাঁর ফুলডাঙার বাড়িতে তাঁরই পাশে বসে কুমড়ো ফুলের বড়া খাচ্ছি আমরা, আমরা কয়েকজন, গলানো সোনার মতো চাঁদ উঠছে শান্তিনিকেতনের আকাশে, ধ্যানগম্ভীর তিনি বসে আছেন--একা, একা এবং কয়েকজন ।
আজ সবই ছবি, শুধু ছবি, আর ছবি, আর ছবি, আর ছবি ! সুনীলদাকে নিয়ে লেখা আর আমার হল না...
(পুনশ্চ: বীরভূমের সাহিত্য পত্রিকাটির নাম এখানে ইচ্ছাকৃতভাবেই অনুল্লেখিত । ওই পত্রিকার সম্পাদক এখন মৃত । তাঁর অকালপ্রয়াণ আমাকে মর্মাহত করেছে । মৃত্যু মানুষকে সমস্ত পার্থিব ক্ষুদ্রতার ঊর্ধে নিয়ে যায় । তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি ।)
[লেখাটি সুখবর পত্রিকায় 7 সেপ্টেম্বর, 2023 প্রকাশিত]
(ছবিঋণ : আনন্দবাজার, উইকিপিডিয়া, বিবিসি বাংলা ।)



Comments