top of page
Search

আন্তর্জাতিক সেবিকা দিবস : আলো, আরও আলো...



(আজ ১২ মে । আন্তর্জাতিক সেবিকা দিবস । এই সুযোগে কিছু আলো খোঁজা... )


ree

১২ মে দিনটি সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক সেবিকা দিবস বা ইন্টারন্যাশনাল নার্স ডে হিসেবে উদযাপিত হয়, আমরা সবাই জানি । কেন এই বিশেষ দিনটি বেছে নেওয়া হয়েছে, তাও আমাদের অজানা নয় । ১৮২০ সালের এই দিনেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন আধুনিক নার্সিং ব্যবস্থার জননী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, যিনি 'লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প' নামে ইতিহাস অমর হয়ে আছেন । ধনকুবের বাবা উইলিয়াম এডওয়ার্ড শোর, যিনি পরবর্তীকালে নাইটিঙ্গেল উপাধিপ্রাপ্ত হন, স্ত্রী ফ্রান্সিস স্মিথকে নিয়ে ইতালির ফ্লোরেন্স ভ্রমণ করতে গেলে, সেখানেই জন্ম হয় ফ্লোরেন্সের ।


ছোটবেলা থেকেই ফ্লোরেন্স অত্যন্ত মেধাবী । খুব অল্প বয়সেই গণিত, সাহিত্য ও বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন । কিন্তু ইংল্যান্ডের উচ্চবিত্ত শ্রেণির জীবনযাপনের আদবকায়দা তাঁকে বেশি দিন বেঁধে রাখতে পারেনি । তাঁর মন অস্থির হয়ে ওঠে আবিশ্ব মানুষের রোগ-যন্ত্রণা-আর্তনাদে । আর্তের সেবাকেই তিনি নিজের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন খুব ছোট অবস্থাতেই । নার্সিং পেশার জন্য নিজেকে তিলে তিলে তৈরি করতে থাকেন, ট্রেনিং নেন । কিন্তু বাবা-মা চাননি মেয়ে সেবিকা হোক । তাই ফ্লোরেন্স বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন । কর্মজীবন শুরু করেন লন্ডনের 'এস্টাবলিশমেন্ট ফর জেন্টল উইমেন ডিউরিং ইলনেস' নামের প্রখ্যাত এক প্রতিষ্ঠানের সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে ।


ree

এর পরের ইতিহাস তো সকলেরই জানা । ১৮৫৪ সাল । যুদ্ধ বাধল ক্রিমিয়ায় । শ'য়ে শ'য়ে মানুষ আক্রান্ত । আহত ব্রিটিশ সেনারা ভর্তি হতে লাগলেন ইস্তানবুলের বারাক হাসপাতালে । হাসপাতাল তো নয়, নরক ! নোংরা ঘরদোর, মলমূত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, চতুর্দিকে আবর্জনার স্তূপ । চিকিৎসা ? এখানে ভর্তি মানেই ধরে নেওয়া যায় মৃত্যু । অসমসাহসী ফ্লোরেন্স তাঁর বিশাল প্রশিক্ষিত সেবিকাবাহিনী সমেত এখানেই উপস্থিত হলেন মানবসেবার ব্রত নিয়ে । নিরলস পরিশ্রম করে পালটে দিলেন হাসপাতালের চেহারাটাই । তাঁর নেতৃত্বে সেবিকাবাহিনীর বিনিদ্র সেবায় অনেক মৃত্যুপথযাত্রী সৈনিক আস্তে আস্তে সুস্থ হতে লাগলেন । রাতভর প্রতিটি মুমূর্ষু সেনার কাছে বাতি হাতে এই নাইটিঙ্গেল গুটিগুটি পায়ে পৌঁছে যেতেন, আর পরম মমতায় তাঁদের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ করে তুলতেন একটু একটু করে । সারা পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যমে এই খবর পৌঁছতে শুরু করল আর পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ল এই মহীয়সীর নাম । পরবর্তীকালে ব্রিটেনে যে রয়‍্যাল কমিশন গঠিত হয়, তাও এই  নাইটিঙ্গেলেরই সুপারিশে । শুধু কি ব্রিটেন, তাঁর মূল্যবান পরামর্শেই সারা পৃথিবীর স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এক সময়ে । এমনকী, এ দেশের গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়েও তিনি গবেষণা করেছিলেন, দিয়েছিলেন মূল্যবান পরামর্শ । প্রকৃত অর্থেই তিনি আধুনিক নার্সিং ব্যবস্থার পথিকৃৎ । আজীবন সেবার প্রতিমূর্তি এই মহিলা, শোনা যায়, প্রেমিকের বিবাহ প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন স্রেফ মানবসেবার কারণেই । তিনি বুঝেছিলেন, গোলাপের বিছানা তাঁর জন্য নয়, আর্তের সেবায় জীবনোৎসর্গেই তাঁর মুক্তি ।


ree

সেবিকাদের মধ্যে এই আত্মোৎসর্গের ব্রত আজকাল আর দেখা যায় না বড় একটা, এ রকম শুনি । নার্সিংকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে আজকালকার মেয়েরা স্রেফ আর পাঁচটা পেশার মতো অর্থ উপার্জনকেই একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে ধরে নেন, এ রকম মন্তব্য বা অভিজ্ঞতালব্ধ বিবৃতি রাস্তাঘাটে, ট্রেনেবাসে আকছাড় শোনা যায় আজ । শোনা যায় যখন, পুরোপুরিই তা মিথ্যে নয় নিশ্চয় । আর শুধু যে শোনা যায় তা তো নয়, বিভিন্ন হাসপাতাল কিংবা নার্সিংহোমে কিছু কিছু সেবিকার নিষ্ঠুর আচরণ, কর্তব্যে গাফিলতি কিংবা নিদারুণ সেবাবিমুখতায় মুমূর্ষু রোগীর ভয়াবহ পরিণতির ভুরি ভুরি অভিজ্ঞতা তো হয় ভাগ্যবিড়ম্বিত আত্মীয়-পরিজন হিসেবে আমাদের মধ্যে অনেকেই  ব্যক্তিগত জীবনে অর্জন করি, নয়তো, সাধারণ নাগরিক হিসেবে, প্রায়শই সংবাদমাধ্যমে প্রত্যক্ষ করি ।


এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি, এই সেবিকা সমাজের মধ্যেই নাইটিঙ্গেলের ছায়া আজও আছে, এবং বিশ্বাসের জোরে বলা যায়, ভবিষ্যতেও থাকবে । বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিকের একটি ছোট্ট উদাহরণ আমি এখানে তুলে ধরতে চাই । যদি ভুল না করি, ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসের কোনও এক শীতার্ত শেষ রাতে দক্ষিণ কলকাতার এমআরআই হাসপাতালে আগুন লাগলে, রোগশয্যায় বন্দি রোগীরা যখন একের পর এক অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল, সেবার মহান আদর্শে নিবেদিতপ্রাণ দুই সেবিকা, বিনীতা পিকে ও রামায়া রাজাপ্পান, তখন নিজেদের জীবন বিপন্ন করে আমরির গ্যাস চেম্বার থেকে যত বেশি সম্ভব রোগীকে বের করে এনেছিলেন । কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, তাঁরা নিজেরা আর বেরোতে পারেননি মরণকূপ থেকে । কলকাতায় কাজ করতে আসা এই দুই সেবিকার আর ফিরে যাওয়া হয়নি নিজের দেশ কেরলে । আন্তর্জাতিক সেবিকা দিবসে তাঁদের মরণোত্তর পুরস্কারে সম্মানিত করেছিলেন রাষ্ট্রপতি । প্রয়াত বিনীতার পুরস্কার নিয়ে গিয়েছেন তাঁর বাবা, আর অন্যজনের মা ।


ree

এই দৃষ্টান্তই কি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না, পৃথিবীর সব আলো এখনও নিভে যায়নি ? সেই ১৮৫৪ সালের কনস্টান্টিনোপলের বারাক হাসপাতালের অন্ধকার কক্ষ থেকে উৎসারিত যে আলো, এই শতাব্দীর মূল্যবোধ-লাঞ্ছিত কলকাতার দগ্ধ এমআরআইয়ের বিষবাষ্পের অন্ধকারেও তার বিনাশ নেই ! সে আছে, সে ভীষণভাবে আছে ! আমরা অন্ধকার থেকে মুখ ঘুরিয়ে, শুধু আলোটুকুই দেখতে চাই । আলো, আরও আলো...



(নাইটিঙ্গেলের ছবি : উইকিপিডিয়া ।)

 
 
 

Comments


bottom of page