top of page
Search

একটি প্রাণঘাতী টিউমার ও তার শল্যচিকিৎসা



"মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস !

হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ !

বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে !

দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে ।"

('আমার কৈফিয়ত', নজরুল ইসলাম )


ree

এই যে মানুষ খেপে গিয়েছে, সারা পশ্চিমবাংলা জুড়ে এমন তীব্র জনরোষ, এর কারণ শুধুই একটি মৃত্যু নয় কিন্তু । একটি শ্বাপদসমাকীর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মৃত্যুর পিছনের দীর্ঘমেয়াদী শীতল রক্তের চক্রান্ত ও অজস্র অনাগত সমধর্মী মৃত্যুর সম্ভাবনা মানুষকে এমন পাগল করে দিয়েছে ।


নদিয়ার নাবালকের উপর নৃশংস অত্যাচার কি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ? কোনও আকস্মিক ঘটে যাওয়া 'ক্রাইসিস' মাত্র ? যাদবপুরের যে প্রাক্তনী আজ দুই সন্তানের পিতা তিনিও লিখেছেন, "আমার সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়েছিল যে আমিও একটা স্বপ্নদীপ হতে পারতাম !" চোখ বেঁধে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার আগে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, "কীভাবে তোর মা-বাবা মিলন করে ?" তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি তাঁর মায়ের পেটের দিদির সঙ্গে কখনও শারীরিক সম্পর্ক করেছেন কি না, দিদি ভিজে শাড়ি পরলে তাঁকে দেখতে কেমন লাগে ! (সূত্র : সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই প্রাক্তনীর হাড় হিম করা পোস্ট )


এই যে বছরের পর বছর ধরে, দশকের পর দশক ধরে এই গা ঘিনঘিনে বিবমিষা উদ্রেককারী মানসিকতাকে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চার দেওয়ালের মধ্যে সযত্নে লালন করা হয়, এর দায় কার ? যাদবপুর কি এই দায় অস্বীকার করতে পারে ? একটি মনুষ্য সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য নির্মাণে বংশগতি না পরিবেশ (ও শিক্ষা ) কোনটির ভূমিকা কতখানি এ বিষয়ে গ্রেগর জোহান মেন্ডেল ও অন্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে, আমরা জানি । যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া হয়, জন্মসূত্রে বা জিনগত কারণেই এই ধরনের মানসিক বিকৃতি নিয়ে এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে, সে ক্ষেত্রেও অনিবার্যভাবে যে প্রশ্নটি এসে পড়ে, বছরের পর বছর এই বিকলাঙ্গ মানসিকতার সন্তানেরা কেন বিশেষ একটি প্রতিষ্ঠানকেই বেছে নেয় ? দেশে আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি নেই ? তাই এই যুক্তি ঠিক ধোপে টেকে না ! বরং যে যুক্তিটা আরও বেশি প্রকট হয়ে ধরা দেয় তা হল, এই প্রতিষ্ঠানের জল-হাওয়া-শিক্ষা-সংস্কৃতিই তাদের মধ্যে ওই মানসিকতা ইনজেক্ট করছে না তো ? কর্তৃপক্ষের চরমতম উদাসীনতা তাকে লালন করছে না তো ? সম্মৃদ্ধ করছে না তো ? নইলে যে নিম্নবিত্ত পরিবারের মলিন মা কিংবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিন গুজরান করা অসহায় বাবার ছেলে এখানে পড়তে আসছে ভাল রেজাল্ট করে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই পরিবারের ছেলে অমন জান্তব মানসিকতার ড্রাগ আসক্ত ক্রিমিনালে পরিণত হচ্ছে কী করে ? সে কি এখানে আসার আগে ওই হতদরিদ্র পরিবারে অমন মা-বাবার সান্নিধ্যে মাদক নিত ? মদ্যপান করত ? মনে হয় না ।


ree

তা হলে অনিবার্যভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক দায় এড়াতে পারে না যাদবপুর ! (এর মানে কখনওই এই নয়, যাদবপুরে পড়তে আসা সব ছাত্রছাত্রীই মানিসকভাবে অসুস্থ ! বরং সংখ্যাগুরু পড়ুয়া এখানে শুধু পড়তেই আসেন এবং পড়া শেষ করে ভাল রেজাল্ট করে বেরিয়ে যান । ড্রাগ-গাঁজা-চরসের বৃত্তকে তাঁরা সযত্নে এড়িয়ে চলেন । এক কবিবন্ধু শ্বেতা চক্রবর্তী সেদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় দুঃখ করে লিখলেন, "আমি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বি.এ, এম.এ. আর পি.এইচ.ডি করেছি । দীর্ঘ তেরো-চোদ্দ বছরের সম্পর্ক । মদ,গাঁজা বা নেশার কিছু তো এ জীবনে করে উঠতে পারিনি । কলকাতার একটি স্কুলে পড়াই পঁচিশ বছর । হাজার হাজার প্রতিষ্ঠিত ছাত্র আমার সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে । কিন্তু আমায় কোনও কালে এ সবের মুখোমুখি হতে হয়নি ।" খুব সত্যি কথা । কিন্তু এ সত্যিটাও এই প্রাক্তনীদের জানতে হবে, যে মায়ের এক ছেলে ডাক্তার, আরেক ছেলে ডাকাত সেই মা ডাক্তারের মা বলে সমাজে যত না সম্মানিত হন, ডাকাতের মা বলে তাঁকে ঢের বেশি ভর্ৎসিত হতে হয় !)


ree

আর এইখানে অবিসংবাদিত যে প্রশ্নটি উঠে আসবে, ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তা হলে ঠিক কী কারণে বিষবৃক্ষের চাষ করে ? যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঋষি অরবিন্দের নাম, যে প্রতিষ্ঠান এক সময়ে জাতীয়তাবাদের পীঠস্থান বলে পরিচিত ছিল, সেই প্রতিষ্ঠানের কাছে কেন্দ্রীয় নারকোটিক্স বিভাগের নোটিশ আসবে কেন ? তবে কি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নারকো মাফিয়ারা জড়িয়ে আছে ? বিশ্ববিদ্যালয়টি কি আজ দেশে-বিদেশে ড্রাগ পাচারের ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারে পরিণত হয়েছে ? কেন এমন প্রশ্ন উঠছে রাজ্যজুড়ে ? কেন এমন সন্দেহ জাগছে মানুষের মনে ? কেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক ভূতপূর্ব উপাচার্যকে বলতে হয়, গভীর রাতে পাঁচিল টপকে বহিরাগতরা এসে ড্রাগ কেনাবেচা করে এখানে ? কেন তাঁকে আক্ষেপ করতে হয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আজ 'অপরাধীদের মুক্তাঞ্চল' ?


নদিয়ার নাবালকের মৃত্যু হিমশৈলের চূড়ামাত্র ! গভীরে তদন্ত কি পুলিশ করতে পারবে ? রাজ্য সরকার কি সেই ক্ষমতা দেবে পুলিশ-প্রশাসনকে ? কোন সাহসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া মিডিয়ার সামনে বুক বাজিয়ে বলতে পারে, ক্যাম্পাসের মধ্যে মদ্যপান তার অধিকার ? কোন আইনে প্রতিষ্ঠানের ছাত্র চিৎকার করতে পারে, তারা কোনও পরিস্থিতিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সিসিটিভি লাগাতে দেবে না ? ইউজিসি গাইডলাইনকে অস্বীকার করার অধিকার কোথায় পায় ছাত্রছাত্রীরা ? কর্তৃপক্ষ এমন ছাত্রছাত্রীকে রাস্টিকেট করে না কেন ? কোন কায়েমি স্বার্থে বছরের পর বছর ইউজিসি গাইডলাইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বহাল তবিয়তে কাজ করতে পারে কর্তৃপক্ষ ?


ree

পুলিশি জেরায় হোস্টেল সুপার জানিয়েছেন, তিনি ছাত্রদের ভয় পেতেন বলেই ডিন অব স্টুডেন্টসের ফোন পেয়েও ঘটনাস্থলে যাননি ! খুব সত্যি কথা ! শুধু সুপার কেন, প্রোভিসি থেকে শুরু করে, রেজিস্ট্রার থেকে শুরু করে, ডিন অব স্টুডেন্টস থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রত্যেকে ভয় পান ছাত্রদের । তাঁরা জো হুজুর করে টিকে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে । পাঁজরে এমন হিমশীতল ভয় নিয়ে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় শাসন করছেন ! কর্তব্যে এমন ভয়াবহ গাফিলতি সত্ত্বেও, এখনও অবধি, দুর্ভাগ্যের বিষয়, কর্তৃপক্ষের একজনও গ্রেফতার হলেন না ! ১২ জন ছাত্রকে জেলে ভরে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ? ফি বছর যে এমন ডজন ডজন ছাত্রছাত্রীর জন্ম দিচ্ছে যাদবপুর ! সযত্নে তাদের লালনপালন করছে কর্তৃপক্ষ ! এদের কী হবে ? এরা তো পাঠ শেষ করে মিশে যাচ্ছে সমাজের মূল স্রোতে, ছড়িয়ে পড়ছে দেশে-বিদেশে, অফিস-কাছাড়িতে, হয়তো বা, আমার আপনার পাশের বাড়িতেও !


ree

আজ নদিয়ার ছেলেটা মারা গিয়েছে বলেই সামনে এসেছে এই মানসিক বিকার, আছড়ে পড়েছে সুনামির মতো ! মৃত্যুটা না ঘটলে ওই বিকার সামনে আসত না । তাই বলে কি মিথ্যে হয়ে যেত বিকারটা ? যাদবপুরের অঙ্গে অঙ্গে আজ প্রাণঘাতী ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে এই টিউমাররূপী বিকার । এতই দানবীয় তার রূপ, এতই পুঁজ-রক্ত-পোকায় বীভৎস সেই আলসার, যে আর ওষুধে কাজ হবার নয় । একবার অস্ত্রোপচারের শেষ চেষ্টা করে দেখতে হবে ! তার জন্য প্রয়োজন সুযোগ্য শল্যচিকিৎসকের । একমাত্র তিনিই বাঁচাতে পারেন মুমূর্ষু যাদবপুরকে । আর আমরাও সর্বমঙ্গলময়ের কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করি, প্রাণঘাতী টিউমারটিকে শেকড়সুদ্ধ ছেঁটে ফেলে আমাদের প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে তুমি বাঁচাও ঈশ্বর !


ছবিঋণ : এবিপি আনন্দ, নিউজ 18 বাংলা

(লেখাটি 24 অগস্ট, 2023 দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় প্রকাশিত )


 
 
 

Comments


bottom of page