top of page
Search

কেন এত আত্মহত্যা ?




(আজ ২৮ মার্চ । ১৯৪১ সালে ঠিক এই দিনেই আত্মহত্যা করেন প্রখ্যাত ইংরেজ কথাসাহিত্যিক ভার্জিনিয়া উলফ । আত্মহত্যা কেন করেন সফল মানুষ ? এই অভিশাপ থেকে কি মুক্তি নেই ? একটি আত্মমগ্ন আলোচনা ।)


ree

সেটা ১৯৪১ সাল । মার্চ মাস । বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজ কথাসাহিত্যিক ভার্জিনিয়া উলফ সদ্য শেষ করেছেন তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস 'বিটুইন দ্য অ্যাক্টস' । মনে হয়, এর পর আর কিছু লেখা তিনি সমীচীন মনে করেননি । সমীচীন মনে করেননি বেঁচে থাকাটাও । থাকতেন তখন সাসেক্সের রডমেলে । বাড়ি পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আউস নদী । নদী কি ডেকেছিল তাঁকে ? হ্যাঁ ডেকেছিল তো ! ওই নদীতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি । ২৮ তারিখ । ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে মৃত্যু নিশ্চিত করতে পোশাকের সমস্ত পকেটে পুরে নিয়েছিলেন ভারী পাথর ।


ree

ভার্জিনিয়া উলফ, আপনারা সবাই জানেন, বিশ শতকের কথাসাহিত্যে একটা নতুন ধারার অন্যতম সফল কান্ডারি । তামাম দুনিয়া তাঁকে চেনে । কিন্তু মনামি চৌধুরী ? কে তাঁকে চেনেন ? এই বাংলার এক অতি সাধারণ উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের এক যুবতী গৃহবধূ ! অর্থনৈতিক অস্বাচ্ছন্দ্য নেই, সামাজিক অসম্মান নেই, সাংসারিক অশান্তিও নেই । স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের ঘরকন্না ! অবৈধ সম্পর্ক ? অন্তত ছিদ্রান্বেষী কিংবা সন্দেহবাতিকেরাও এ প্রশ্ন তোলেননি । তবে ? তবে সাগরপারের বিশ্ববন্দিত কথাসাহিত্যিকের সঙ্গে দূর তৃতীয় বিশ্বের অনামা গৃহবধূর মিল কোথায় ? আছে । তিনিও কোনও অনির্দেশ্য অন্তর্বেদনায় ২৮ খানা ঘুমের বড়ি খেয়ে এই সে দিন শেষবারের মতো ঘুমোতে চলে গেলেন সাদা ধবধবে চাদরে মোড়া পাখির পালকের মতো নরম তুলতুলে গদির ডিভানে !


ree

আত্মহত্যা আজ বড় ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে সারা পৃথিবীতে । কিন্তু কেন এত আত্মহত্যা ? এর পেছনে কারণ কী ? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO বলছে, বিশ্বব্যাপী আত্মঘাতী মানুষের সংখ্যা ভয়াবহভাবে ক্রমবর্ধমান । এবং, আশ্চর্য এই, সেখানে আমাদের দেশের অবস্থান খুব ওপরের দিকে । আরও আশ্চর্যের বিষয়, আমাদের দেশের মধ্যে আবার আমাদের রাজ্যের স্থানও খুব ওপরের দিকে । কে বলে বাঙালিরা পিছিয়ে পড়ছে ? আমরা শিক্ষায় পিছিয়ে পড়তে পারি, সংস্কৃতিতে পিছিয়ে পড়তে পারি, আরেকটা সৌরভ গাঙ্গুলি তৈরি করতে না পারি, আত্মহত্যায় তো পিছিয়ে পড়িনি !


একটি সাম্প্রতিক সরকারি রিপোর্ট বলছে, নারী ও পুরুষের আত্মহননের কারণ পৃথক । বেশিরভাগ পুরুষের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কারণ হল অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থা; কিন্তু বেশিরভাগ নারীর ক্ষেত্রে কারণটা সম্পূর্ণ ভিন্ন । একান্ত নিবিড় ব্যক্তিগত কারণেই মহিলাদের একটি বৃহত্তর অংশ আত্মহননের পথ বেছে নেন । এই নিবিড় ব্যক্তিগত কারণগুলির একটি অবশ্যই নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব । এই নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব থেকেই জন্ম নেয় 'সেন্স অব নেগলিজেন্স', যা ভয়াবহ মানসিক রোগ সৃষ্টি করে অচিরেই । আর এই মানসিক রোগ প্রকট আকার ধারণ করলেই রোগী হয়ে ওঠেন আত্মহত্যাপ্রবণ ।


ree

আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হলে উপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন, বলা বাহুল্য । কিন্তু এই চিকিৎসা আর পাঁচটা রোগের চিকিৎসার থেকে ভিন্ন । এ ক্ষেত্রে যে পরিকাঠামোর প্রয়োজন হয়, দুঃখের বিষয়, আমাদের রাজ্যে তো নেই-ই, সারা ভারতবর্ষেই সে ব্যবস্থা অপ্রতুল । অথচ উন্নততর পরিষেবার লক্ষ্যে উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণের কোনও সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ে না বড় একটা ।  আত্মহত্যার প্রকরণ শেখাতে, আশ্চর্য হলেও সত্যি, বিপুল অর্থব্যয়ে চলচ্চিত্র তৈরি হয় এ দেশে, এই বাংলায়; অথচ আত্মহত্যার হাত থেকে মানুষকে--সমাজকে--বাঁচাতে তেমন কোনও প্রচেষ্টাই লক্ষ করা যাচ্ছে না কোথাও, এমনই আত্মঘাতী আমরা ।


বেঙ্গালুরুর নিমহানস থেকে পাস করা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক, ড. সৌগত বসুর কথা খুব মনে পড়ছে এই প্রসঙ্গে । মানসিক রোগ-অবসাদ-যন্ত্রণা-নিঃসঙ্গতাকে ভয় পেয়ে বা সহানুভূতি জানিয়ে নয়, এগুলো নিয়েই মনুষ্যত্বকে সম্মান জানিয়ে কীভাবে অন্তর্নিহিত শক্তিতে শক্তিমান হয়ে বেঁচে থাকা যায়, এই ছিল তাঁর গবেষণার বিষয় । মানসিক শক্তিই বেঁচে থাকার উৎস, কিন্তু এই মানসিক শক্তির উৎসগুলি কী কী, সেগুলোকে খুঁজে বের করাই ছিল তাঁর কাজ । মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থা 'মন ফাউন্ডেশনে'র সভাপতি এই বিশিষ্ট গবেষক খুব অল্প বয়সে অকালে চলে গিয়েছেন । যাওয়ার কয়েক দিন আগে তিনি যা বলে গিয়েছেন তা আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের কাছে মহৌষধি রূপে কাজ করতে পারে বলে মনে হয়, "মৃত্যুকে নয়, শ্বাসকষ্টটাকে ভয় পেতাম । আর পাই না । কষ্টটা তো সাময়িক । হয় চিকিৎসায় কষ্ট কমবে, নয়তো মৃত্যুতে । কষ্টের ভয় আর আমার আনন্দকে নষ্ট করবে না ।"


কষ্টের মধ্যেও আনন্দকে খুঁজে পাওয়াই তো বেঁচে থাকা । এই অন্বেষণ সফল হলে, মানুষ আর আত্মহত্যার পথে পা বাড়াবে না ।


(ছবিঋণ : উইকিপিডিয়া ।)

 
 
 

Comments


bottom of page