top of page
Search

কর্মে মহান হবে


ree

যে ছেলেটির কথা দিয়ে এই লেখা শুরু করছি, তার বয়স নিতান্তই অল্প, বড়জোর ২৪ । অত্যন্ত মেধাবী ছেলেটি । ধরা যাক তার নাম শৌণক--শৌণক চ্যাটার্জি । মাধ্যমিক দিয়েছিল নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে । পড়াশোনার সঙ্গে কুইজ-নাটক-খেলাধুলো সহ আরও অনেক কিছু চর্চা করত মন দিয়ে । মনে ছিল প্রবল ইচ্ছে--বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করার । হায়ার সেকেন্ডারিতে সাইন্সে বেশ ভাল রেজাল্ট করল ছেলেটি । জয়েন্ট এনট্রান্সে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেল বাইরে । বাংলা পড়া আর হল না তার ! কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিংকে কোনও দিনই ভালবাসতে পারল না মন থেকে । ইতিমধ্যে পাশ করে চাকরিতে জয়েনও করল--সেক্টর ফাইভের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় ।


চাকরিতে দু'বছর পূর্ণ হতে চলেছে তার । ইতিমধ্যেই কিবোর্ডের মাউসের হালকা কিন্তু মারণ চাপে হাঁপিয়ে উঠেছে জীবন । তবু বেরোতে পারছে না । কী করবে সে এখন ? চাকরি সূত্রে কিছু দিন পরেই ইংল্যান্ড যাওয়ার কথা, কিন্তু মনে তো আনন্দ নেই ! সে চায় না এই চাকরি কন্টিনিউ করতে । স্পোর্টস তার পুরনো প্যাশন । স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট পড়ার ভীষণ ইচ্ছে । সে কি যাবে স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট পড়তে ? ছেড়ে দেবে এই চাকরি ? সীমাহীন দোদুল্যমানতায় ভুগছে ছেলে । সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না । মনের শান্তিটা আগে দেখবে, নাকি সমাজের তালে তাল মেলাবে ? বাংলা নিয়ে পড়া, লেখালেখি, রেডিয়ো স্টেশনে শো পরিচালনা...অনেক সুযোগ এবং স্বপ্ন তো  ছেড়েছে পরপর ! এইভাবে এই স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টের স্বপ্নটাও কি ছেড়ে দেবে, নাকি মোটা মাইনের আরামের জীবনকে গুডবাই করে আবার ফিরে আসবে ছাত্রজীবনে ?


ree

শুধু শৌণকই নয়, কর্মজীবনের এই সমস্যা বেশিরভাগ সৃজনধর্মী, সংবেদনশীল মানুষকেই কম বেশি পীড়িত করে, কারণ পছন্দের কাজ না-পাওয়ায় অধিকাংশ কর্মজীবী মানুষই সন্তুষ্ট হতে পারেন না । দৈনন্দিন অপ্রিয় কাজের একঘেয়েমি তাঁদের ক্লান্ত করে, অবসন্ন করে তোলে । মন তখন সব কিছু ছেড়ে দিতে চায় । কিন্তু বাদ সাধে টাকা । অর্থের গুরুত্বকে কোনও প্রকারেই অস্বীকার করা যায় না, সত্যি কথা বলতে কী, করা সম্ভবও নয় । আর এই জন্যই, মনের সাড়া না থাকা সত্ত্বেও, অপছন্দের জায়গায় দিনের পর দিন আটকে থেকে কাজ করে যেতে হয় মুখ বুজে । এর ফলে কাজের উৎকর্ষ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা খুব স্বাভাবিক হয়ে পড়ে । বিশেষত সরকারি চাকরিতে এই প্রশ্ন তীব্রভাবে এসে পড়ে, যেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো কড়া অনুশাসন বা চোখরাঙানির ছিটেফোঁটাও নেই । বেসরকারি ক্ষেত্রে উৎকর্ষের অবনমন হলে, একটা অনিশ্চয়তার সংশয় কাজ করে বলেই, সেখানে সরকারি ক্ষেত্রের মতো অনিয়ম বা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এত ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে না । অবিশ্যি, সেখানেও, অন্তরের সাড়া না থাকলে একটা অন্তঃসারশূন্যতার পরিমণ্ডল লক্ষ করা যায় ।


ree

শৌণক হয়তো চাকরিটা ছেড়েই দেবে, স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়বার ঝুঁকি গ্রহণ করবে সে । কারণ, সে সীমাহীন মনের জোরের অধিকারী । অধিকন্তু, তার মা-বাবা আছেন শৌণকের ইচ্ছের সঙ্গে । প্রথমত, তাঁরা অত্যন্ত সংস্কারমুক্ত উদার মনের মানুষ; দ্বিতীয়ত, ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ নিলে পরিণতি কী হয়, ছেলের জীবন দিয়ে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা তাঁরা অর্জন করেছেন; তৃতীয়ত--এবং সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ--অর্থনৈতিকভাবে তাঁরা যথেষ্ট সচ্ছল । কিন্তু কতজন শৌণক একটা নিশ্চিত নিরাপত্তার জীবন উপেক্ষা করে, সমাজের মূল স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতরে, নিজের পছন্দের কাজের আকর্ষণে চূড়ান্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে আবার নতুন করে শুরু করতে পারে ? এ কি সম্ভব ? বিশ্ববিশ্রুত কবি কিপলিংয়ের সেই বিখ্যাত কবিতার চরণ মনে পড়ছে, "...Or watch the things you gave your life to, broken, / And stoop and build 'em up with worn-out tools; / If you can make one heap of all your winnings / And risk it on one turn of pitch--and--toss / And lose, and start again at your beginnings / And never breathe a word about your loss..."


এই যে শর্তগুলি কবি দিচ্ছেন--এবং এর সঙ্গে আরও অনেকগুলি--কোনও মানুষ সঠিকভাবে মানতে পারলে, কবি বলছেন, পৃথিবী এবং পৃথিবীর সমস্ত কিছুই নাকি তার অধিকারে আসবে, এবং--আরও গুরুত্বপূর্ণ যেটা--সে একজন প্রকৃত মানুষ রূপে গণ্য হবে ! বাস্তবে কিন্তু এই শর্তগুলি মানা কোনও মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়, এবং এখানেই কবিতাটির সেন্স অফ হিউমর । সে যা-ই হোক--কবিতার নন্দনতত্ত্ব বিশ্লেষণ এখানে অভীপ্সিত নয়--আসল কথা হচ্ছে, জীবন দিয়ে গড়া জিনিসগুলি--এখানে, সারা জীবন কঠিন পরিশ্রম করে পড়ালেখা করে একটি চাকরি জোগাড় করা--ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে দেখেও, নত হয়ে সেগুলি কুড়িয়ে নিয়ে অম্লান বদনে আবার নতুন করে শুরু করা--এখানে, আবার নতুন একটা চাকরির জন্য ফের পড়াশোনা শুরু করে দেওয়া--বাস্তবে প্রায় অসম্ভব । আর অসম্ভব বলেই আমাদের কর্মক্ষেত্রে কাজের উৎকর্ষ ক্রমশ নিম্নাভিমুখী হতে হতে প্রায় তলানিতে পৌঁছে, ভয়াবহ অকর্মণ্যতা সমাজ তথা রাষ্ট্রকে স্থবিরতা প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে দিচ্ছে । ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে আমাদের দেশ--শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে...সর্বত্র ।


ree

আমেরিকা-ইউরোপের অনেকানেক দেশে ছাত্রাবস্থাতেই নাগরিকের দক্ষতা ও মানসিকতা যাচাই করে, তাকে তার উপযুক্ত পেশার যোগ্য করে গড়ে তোলা হয় । এর ফলে ওই সব দেশ কত কর্মমুখী, কত উদ্যমী ! বিশ্বের দরবারে তারা বরাবরই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে চলেছে । আর আমরা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি, ভারতীয়রা, কেবলই পিছিয়ে পড়ছি আন্তর্জাতিক মানচিত্রে । আমরা কবে বুঝব, জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে নিতে গেলে সবার আগে কর্মে মহান হতে হবে ? কবে আর আমরা জানব, দেশের প্রতিটি নাগরিকের একান্ত নিজস্ব ক্ষমতা ও দক্ষতাটুকু সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে মানবসম্পদের যথার্থ ব্যবহারোপযোগিতার মধ্যেই নিহিত থাকে একটি রাষ্ট্রের স্থবিরতা মুক্তির ঠিকানা ?

 
 
 

Comments


bottom of page