গৌরী ঘোষ : বাংলা কবিতার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
- rajatsubhrablog
- Aug 26, 2023
- 3 min read
(আজ ২৬ অগস্ট । গৌরী ঘোষের মৃত্যুদিন । বাংলাদেশ সরকারের 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মান' ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'কাজী সব্যসাচী সম্মানে' ভূষিত প্রবাদপ্রতিম আবৃত্তিশিল্পী গৌরী ঘোষের তুলনা তিনি নিজেই । কিছু স্মৃতি, ফিরে দেখা...)

কত দিন হয়ে গেল গৌরীদি নেই ! ২০২১-এর ২৬ অগস্ট তিনি চলে গিয়েছেন আমাদের ছেড়ে । গৌরীদির চলে যাওয়া আমার ব্যক্তিগত জীবনে যেমন বিরাট ক্ষত তৈরি করেছে, বাংলার সাংষ্কৃতিক জীবনেও তেমনি কম ক্ষত তৈরি করেনি এই মৃত্যু । আবৃত্তিশিল্পকে উৎকর্ষের চরম সীমায় নিয়ে গিয়েছিলেন গৌরীদি, আজকের নামী শিল্পীদের কাজ আসলে তাঁরই প্রদর্শিত পথে খানিক আঁকাবাঁকা চলাচল মাত্র--যে উদ্ভাবনী নতুনত্বের পথ তিনি আবিষ্কার করে দিয়ে গিয়েছেন, সে-পথেই আলুথালু যাতায়াত আজকের বাংলা বাচিকশিল্পের । আমি ভাগ্যবান যে আমার অজস্র কবিতা শিল্পী ভালবেসে তুলে নিয়েছিলেন তাঁর সোনার কণ্ঠে ।
একবার, খুব মনে পড়ছে, সৌমিত্রদার আবৃত্তিলোকের কবিতা উৎসবে 'নিশানদিহি' কবিতাটি পড়ে মঞ্চ থেকে নেমে আসছি । তিন-চারজন তরুণ কবি/বাচিকশিল্পী আমার কাছে এগিয়ে এসে প্রায় ছোঁ মেরেই পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে নিলেন । এই ঘটনায় আমি যত না বিস্মিত ও পুলকিত হয়েছি--বলা বাহুল্য, একজন কবি বা লেখকের লেখা জনমানসে সমাদৃত হলে তাঁর পুলকের অন্ত থাকে না, আমিও এ নিয়মের ব্যতিক্রম নই--তার থেকে সহস্রগুণ বেশি অভিভূত হয়েছি খানিক পরেই দর্শকাসনে বসে থাকা গৌরীদির প্রতিক্রিয়ায় । গৌরী ঘোষের মতো একজন প্রবাদপ্রতিম আবৃত্তিশিল্পী যে এমন একটি তুচ্ছ ঘটনা নিবিষ্ট চিত্তে ও স্নেহাতুর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিলেন অনতিদূর থেকে, তা ছিল আমার কল্পনার অতীত । তিনি আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে পিঠে হাত দিয়ে বললেন, "ভারী সুন্দর কবিতাটি । আমি এই কবিতাটি আবৃত্তি করতে চাই ।" আমার সারা দেহ তখন আকস্মিক বিদ্যুৎতরঙ্গে যেন নিথর নিস্পন্দ হয়ে আসছে, কোনও রকমে শরীর বেঁকিয়ে তাঁর চরণ স্পর্শ করতেই তিনি আমার থুতনি ছুঁয়ে, সে আঙুল নিজের ঠোঁটে ঠেকালেন । কী যে অনির্বচনীয় সেই অনুভূতি ! কোনও দিন ভোলা সম্ভব নয় ! তারপর থেকে কত জায়গায়, কবিতার ঠেকে কিংবা অনুষ্ঠানে, স্টুডিয়োয় কিংবা ঘরোয়া আড্ডায়, আমার উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতিতে, তিনি যে কতবার কত মানুষের কাছে সে দিনের গল্প করেছেন তার ইয়ত্তা নেই ! "রজত মঞ্চ থেকে নামতে নামতে যেভাবে ওর কবিতাটি হাইজ্যাকড হয়ে গেল..." কোট আনকোট উদ্ধৃত গৌরীদির এই উচ্চারণ আমাকে আজও অনুপ্রাণিত করে কবিতা লিখতে ।

'নিশানদিহি' কবিতা তাঁর গলায় রেকর্ড হয়েছিল যত দূর মনে পড়ে ২০১২ সালে কৌশিকদার ধুন স্টুডিয়োও । বলা বাহুল্য, তাঁর কণ্ঠের অপরূপ শিল্প মাধুর্যে এ কবিতা আলাদা মাত্রা পেয়েছিল । পরবর্তীতে এই কবিতাটি নিয়ে কবিতামুভিও তৈরি হয়েছে । আরেকটি কবিতামুভির কথা খুব মনে পড়ছে এই মুহূর্তে--'আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু ।' এই কবিতাটির রেকর্ডিংয়ের স্মৃতি আরও অমলিন হয়ে আছে একটি বিশেষ ব্যক্তিগত কারণে । সেটা হল, তাঁর বাড়িতে তাঁরই হাতে খাওয়াদাওয়া সেরে সে দিন আমরা দমদম থেকে বেরিয়েছিলাম স্টুডিয়োর উদ্দেশে । আমাদের সঙ্গে ছিলেন পার্থদাও--পার্থ ঘোষ । আহা, কী অপূর্ব মানুষ ! একজন ধ্রুবতারার মতো শিল্পী যে এমন ধুলোর মানুষ হতে পারেন, তাঁর সঙ্গে না মিশলে আমার অজানাই থেকে যেত । তিনিও ভালবেসে আমার অসংখ্য কবিতা তুলে নিয়েছিলেন তাঁর কণ্ঠে । কিন্তু সে গল্প আজ নয়, তাঁকে নিয়ে না হয় আরেক দিন লেখা যাবে ।

তো যে কথা বলছিলাম, 'আছে দুঃখ আছে মৃত্যু' একটি দীর্ঘ কবিতা, ২০০৯ সালের দেশ পত্রিকার ২ জুলাই, বিশেষ সংখ্যায় বেরিয়েছিল পুরো তিন পাতা জুড়ে । কবিতাটির রেকর্ডিংয়ের সময়ে আমি গৌরীদির চোখে জল দেখেছিলাম । রেকর্ডিংয়ের পর যখন শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে কাচের ঘর থেকে কন্ট্রোল রুমে এসে বসলেন আমার পাশে, তখনও চোখ ছলছল করছিল তাঁর । বুঝলাম, কবির কবিতাকে আবৃত্তিশিল্পী কতখানি নিজের করে নিলে এমন অশ্রুপাত সম্ভব । একটি মৃত্যুর কবিতাকে তিনি নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন বলেই অমন অমোঘ অননুকরণীয় শিল্প সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল । পরে আমার সঙ্গে সহমত হয়ে তিনি ফিসফিস করে বলেছিলেন, "আবৃত্তির জন্য প্রশিক্ষণের দরকার হয় না রজত, কবিতটিকে হৃদয়ঙ্গম করে কবির থেকে কেড়ে নিয়ে নিজের কবিতা করে নিলেই হয় ! আমরা কার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছি বলতে পারো ?" আহা, কী অপূর্ব এই উপলব্ধি, কী সত্য, সুন্দর ! অবশ্য এ সব কথা জোরে বলা বারণ, আজকের তোতাপাখি সদৃশ আবৃত্তি পটীয়সীরা আমার বিরুদ্ধে 'ভাতে মারার' অভিযোগ আনবেন নিঃসন্দেহে ।
'আছে দুঃখ আছে মৃত্যু'র অডিয়ো ভার্সন তিনি শুনে খুশি হলেও, আমার দুর্ভাগ্য, এই মুভিটি তিনি দেখে যেতে পারেননি । পরিচালক হিসেবে মুভিটিতে একটি বিশেষ জায়গায় আমি খুব সার্টেল সুপারন্যাচারাল এলিমেন্ট যোগ করে এক্সপেরিমেন্ট করার চেষ্টা করেছি । এ নিয়ে আলোচনাও করেছিলাম দিদির সঙ্গে, পার্থদার সঙ্গেও । দু'জনেই উৎসাহিত করেছিলেন । কিন্তু আমারই গড়িমসিতে কাজ শুরু হতে দেরি হয়েছে বিস্তর । তারপর যদি বা শুরু হল, মহামারী এসে সব ওলটপালট করে দিল । বন্ধ হল কাজ, অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হল ।
মহামারি অবরুদ্ধ করল জীবন । তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়াও বন্ধ হয়ে গেল । কীভাবে যাব শান্তিনিকেতন থেকে দমদম ? ফোনে কথা হত । তাঁকে করোনাবিধি বোঝাব কী, তিনিই বারবার এ বিষয়ে সচেতন করতেন আমাদের । যদিও নানা রকম রোগে ভুগছিলেন সে সময়ে । শরীর ক্রমাগত খারাপ হচ্ছিল । তারপর ২১ সালের আগস্টের মাঝামাঝি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হল । ভর্তি করা হল আর এন টেগরে । অবস্থার আরও অবনতি হলে, শেষে ভেন্টিলেশন সাপোর্টে নিয়ে যাওয়া হল । সেখান থেকে আর ফেরানো গেল না । এল অভিশপ্ত ২৬ আগস্ট । সব শেষ ! চলে গেলেন বাংলা কবিতার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় !
হ্যাঁ, আমরা আড়ালে তাঁকে ওই নামেই ডাকতাম । কত স্মৃতি ভিড় করে আছে মনে ! এই সব নিয়েই বেঁচে থাকা...
(ছবিঋণ : আনন্দবাজার পত্রিকা ।)



Comments