দুটি মৃত্যু কবিকে বিবর্তিত করে দেয়
- rajatsubhrablog
- Oct 29, 2023
- 4 min read
(২৮ অক্টোবর কবি সুবোধ সরকারের জন্মদিন । দু'-দুটো মৃত্যু তাঁর কবিতামনন ও কবিতাদর্শনকে বদলে দিয়েছিল আমূল । একটি ব্যক্তিগত আলোচনা । )

সেটা ২০১০ সালের অক্টোবর মাস । সুনীলদার আমন্ত্রণে দিল্লি গিয়েছি একটা সেমিনারে । সাহিত্য আকাদেমির মূল ভবনের দোতলায় দাঁড়িয়ে আছি, অডিটোরিয়ামের বাইরের বারান্দায় । হঠাৎ দেখা সুবোধদার সঙ্গে । সৌজন্য বিনিময় করতেই আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, "তোমরা কবে এসেছ ?" আমার সঙ্গে ছিলেন আমাদেরই সমসাময়িক আরেক কবিবন্ধু । সুবোধদার চোখে তখন ভীষণ ঘর-কাতরতা, বললেন, "আর ভাল লাগছে না । একদম টানা ১০ দিন ধরে পড়ে আছি এখানে । আজ রাতের ফ্লাইটেই বাড়ি ফিরে যাব । কাল সকালে পোনা মাছের ঝোল দিয়ে ঘরের ভাত খাব । কত দিন যে বাড়িতে খাইনি..."
এত কথা এ জন্যই বলা, তখনও তাঁর কাছে ঘরের আবেদন অপ্রতিরোধ্য । তখনও তাঁর কাছে ঘরের মানে তাঁর ছেলের মুখে "আমাকে ছেড়ে দাও, আমি রেড রোডে গিয়ে শুয়ে থাকতে চাই," হয়ে ওঠেনি ! তখনও তিনি কল্পনা করতে পারেননি, একদিন এমন দিন আসবে, যখন "আমরা বাপ-বেটা একটা বাড়ি খুঁজে পাচ্ছি না" লিখতে হবে তাঁকে ! কিংবা, এত দিন যে ঘরটাকে তিনি রান্নাঘর বলে জানতেন, সেটা আসলে 'চোখের জল' হয়ে দাঁড়াবে একদিন ! তখনও সুবোধ সরকারের কবিতা আমাদের কাছে এই রকম--
"তোমার দু'চোখে আমি ডুবে মরি গ্রীষ্ম আর শীতে
কড়া নাড়ে বসন্তের দিন ।
খুলছি খুলছি বলে উঠে এসে খোলো, আমি দেখি
একটা অঘ্রাণ মাস একটা আশ্বিন ।"
তখনও সুবোধ সরকারের কবিতায় প্রেমের আবেদন এই রকম--
"বহু পুরুষের কাছেও গিয়ে যারা সুখী হতে পারেনি জীবনে
নৃতত্ত্ব জানত তারা, জানত না ভালইবাসতে
কত কষ্টে পার হই বঙ্গদেশ, পঙ্গপাল, মারী
মড়ক পেরিয়ে তুমি পারবে না আবার আসতে ?"

তখন মড়ক লেগে গিয়েছে । তারপর এল সেই দিন ! ২৮ মে, ২০১১ । অভিশপ্ত ওই দিনটাই কবির সব দর্শন, চিন্তা-চৈতন্য, বোধ ও বোধি ওলটপালট করে দিল, তছনছ করে দিল । বাংলা কবিতা পেল এক নতুন সুবোধ সরকারকে । এই সুবোধ সরকারের জীবনদর্শন, প্রেম-চেতনা আগের চেয়ে কত ভিন্ন, পাঠক লক্ষ করুন--কবি ঘুমোতে পারছেন না, রাত দুটোয় দেয়ালে পিঠ দিয়ে তাকিয়ে আছেন, একদিন ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়ল এক নারী--"আমি গঙ্গা, দেরি হয়ে গেল আসতে / পিএইচ. ডি শেষ করে আমি তোমাকে ঘুম পাড়াতে এলাম..." ; আরেক দিন কবি যখন খেতে পারছিলেন না, গা গুলোচ্ছিল, ছেলে সব চেয়ে দামি রেস্তরাঁয় নিয়ে গিয়ে প্রন, চিকেন, মাটন, হ্যাম, অয়েস্টার...সব খাইয়ে আনল, অথচ কবির খিদে খুলছে না, এক নারী এসে বলল, "আমি আগুনের পরশমণি, আমাকে খাও " ; আরেক দিন কবি যখন বই পড়তে পারছিলেন না, দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছিল টাইট জিন্স পরা আরেক নারী--অরুন্ধতী--"আমাকে পড়ো, আমি একটা বই / আমার পৃষ্ঠা ওলটাও, আমার আঠা, আমার কাগজের গন্ধ নাও / সদ্য বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে আসা আমি তোমার হট কেক ।" কবি লিখছেন--
"টাইট জিন্স পরা অরুন্ধতী, আগুনের পরশমণি আর গঙ্গা
এরা তিনজন নয়, একজন
বন্দরে বন্দরে যত মেয়ের কাছে আমরা যাই না কেন সোনাগাছি থেকে অমরাবতী আসলে একটাই মেয়ে ।"
বিবর্তিত সুবোধ সরকারের যৌন চেতনার হদিশ পেতে চান ?
"একদা আমি রোজ সেক্স করতাম, খুব ভাল লাগত
করে উঠেই আমি ভাবতাম আবার কখন করব
কিন্তু তোমাকে ভালবাসার পর আমি ক্রমশ বুঝতে পারছি সেক্স না করেও, কামধেনু হয়ে থাকা যায় ।"
এই সুবোধ সরকারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ২০১২-র এক সন্ধেয় শান্তিনিকেতনে একটা কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে । সৌমিত্রদার আবৃত্তিলোকের অনুষ্ঠান সম্ভবত । সেখানেও খুব সাধারণ কথাবার্তা, সৌজন্য বিনিময়, প্রখ্যাত কবিকে অনুজের শ্রদ্ধা প্রদর্শন । কিন্তু ওইটুকুর ভেতরেই একটা ছাইচাপা হাহাকার, একটা নতুন কবিতাবোধ, একটা বিবর্তিত কাব্যোপলব্ধি যেন ফুটে বেরোচ্ছিল তাঁর আপাতত উচ্ছ্বসিত হাসি দিয়ে, লুকোনো খিদে দিয়ে, অপ্রতিরুদ্ধ চোখ দিয়ে । কবিতার পেছনের এই বিবর্তিত কবিতাপুরুষটিই আমার আলোচনার বিষয় শুধু ।

আরও একটা মৃত্যু সুবোধদার নির্মিতিবোধে গভীর, সুদূরপ্রসারী ও অনস্বীকার্য রেখাপাত করে গিয়েছে, সন্দেহ নেই । এ দিনটা হল ২৩ অক্টোবর, ২০১২ । এই দিনের বছর দুই-তিন আগে এবং বছরখানেক পরে লেখা সুবোধদার দুটো কবিতার তুলনামূলক নিঃশব্দ পাঠ তাঁর কাব্যভাবনার রোমাঞ্চকর বিবর্তনকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারবে বলে মনে হয় । যে সুবোধ সরকারকে আমি দেখেছিলাম রওডন স্ট্রিটে শুভমের ছ'তলায় সুনীলদার ঠিক পাশে বসে নিবিষ্ট চিত্তে কবিতা শুনতে ( সে দিন 'কৃত্তিবাসে'র আড্ডায় কবিতাপাঠ ছিল এই লেখকেরও ), নিম্নোধৃত কবিতাটি সেই সুবোধ সরকার অনায়াসেই লিখতে পারেন--
"তোমার একটা চোখ আমি হঠাৎ চুম্বন করেছিলাম
আজ থেকে প্রায় এক লক্ষ বছর আগে
সন্ধেবেলায় মশালের আলোয়
তারপর
সাইপ্রাসে জন্ম নিলাম
সিন্ধু প্রদেশে জন্ম নিলাম
তারপর প্রাগ জ্যোতিষপুরে
তারপর নদীয়া বীরভূম বাসন্তি হরিণঘাটা ২৪ পরগনায়
আমি বারবার জন্ম নিলাম
কিন্তু তোমার আরেকটা চোখ আমি আজও চুম্বন করতে পারিনি ।"
কিন্তু এই লেখার বছর তিন-চার পরে ওই কলম থেকেই যখন বেরিয়ে আসে এই লাইনগুলো--
"আমি তোমাকে নিয়ে দিল্লি গেলাম
ভুবনেশ্বর গেলাম
শিলং গেলাম গেলাম, ফিরেও এলাম
এ রকম আঠারোটা শহর থেকে ফিরেই আমি বললাম এবার তোমাকে নিয়ে আমি বিন্দু বিসর্গ যাব
তুমি বললে সেটা আবার কী ? সেটা কি কোনও জায়গার নাম ?
আমি নৌকো নিলাম, ট্রেন নিলাম,ভ্যান রিকশোতে উঠলাম
সাবমেরিন নিলাম, উড়োজাহাজে উঠলাম
আবার সাইকেলে চড়ে উড়ে বেড়ালাম
নাসার মহাকাশযানে উঠে পড়লাম ।
কিন্তু আজও আমরা খুঁজে পাইনি বিন্দুকে
আর বিসর্গকে ।"
তখন কি মনে হয় না এ আরেক সুবোধ সরকার ? বিবর্তিত সুবোধ সরকার ? আর এই বিবর্তনের মূলে আছে একটা মৃত্যু--হ্যাঁ, সেই মানুষটার মৃত্যু, যে মানুষটা বলেছিলেন, "...কোনও মেয়ের সঙ্গে একবার, / মাত্র একবার হলেই, অমরাবতী হয় ।/ কোনও কোনও মেয়ের সঙ্গে বারংবার হলেও, / বারবার ফিরে আসতে হয় গোমুখ থেকে গঙ্গায় । / আমি সে দিন কথাটা ধরতে পারিনি ।"

পাঠক লক্ষ করুন, কবির অকপট স্বীকারোক্তি --"আমি সে দিন কথাটা ধরতে পারিনি ।" এই স্বীকারোক্তি হাতেগরম আমাদের টেবিলে আসছে ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩-র সকালে, দেশ পত্রিকায় । অর্থাৎ ২৩ অক্টোবর ২০১২-তে যে মৃত্যুশোককে তিনি ধারণ করলেন শরীরে মনে, পাক্কা ১০ মাস ১০ দিনের মাথায় ২ সেপ্টেম্বর ২০১৩-য় একটা উপলব্ধি রূপে প্রসব করলেন তাকে । এই যে শোক থেকে স্বীকারোক্তির জন্ম, কিম্বা উন্মত্ততা থেকে উপলব্ধির--এই নতুন বোধই তো বিবর্তন ঘটায় বিন্যাসের । আর সেই বিবর্তিত বিন্যাসের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমাদের চিরবিতর্কিত কবিতাপুরুষ সদ্য জাতীয় পুরস্কার জেতার পরই, 'সুললিত লিরিক কবিতার পাশের কানাগলি' দিয়ে 'কবিতার গা থেকে গয়না খুলতে খুলতে' কেমন অনায়াস শ্লেষে বলতে পেরেছিলেন --
"প্রতিটি পুরস্কার পকেটে ঢোকার আগে
উঁকি দিয়ে বলে যায়
তুমি ভাল হয়ে চলো
আমিও ভাল হয়ে চলব ।"
যে যা-ই বলুন, আমি কিন্তু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, তিনি আজও "ভাল হয়েই" চলছেন...
[লেখাটি দৈনিক যুগশঙ্খ 29 অক্টোবর, 2023-এ প্রকাশিত]



Comments