নিলাম, নিলাম, তোমার দাম নেই !...
- rajatsubhrablog
- Apr 16, 2023
- 4 min read
(আজ ১৬ এপ্রিল, নিলামদার দিবস । যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অকশনারস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দিবস পালিত হচ্ছে ।)

A public event at which things are sold to the person who offers the most money for them.
(Definition of Auction, Oxford Learner's Dictionary )
A usually public sale of goods or property, where people make higher and higher bids (= offers of money) for each thing, until the thing is sold to the person who will pay most.
(Definition of Auction, Cambridge Dictionary )
তা হলে নিলাম বা 'অকশন' হল কোনও বিশেষ বস্তু বা দ্রব্য কিনতে আগ্রহী একাধিক সমবেত ক্রেতার (ব্যক্তি বা সংস্থা) প্রতিযোগিতার মধ্যে সব থেকে বেশি দামে কিনতে ইচ্ছুক ব্যক্তি বা সংস্থার কাছে ওই দ্রব্য বা বস্তু বিক্রয় । যে ব্যক্তি বা সংস্থা সর্বাপেক্ষা বেশি দাম দিয়ে আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটি কুক্ষিগত করেন, তিনি বা তাঁরাই প্রতিযোগিতায় জয়ী বলে গণ্য হন । নিলাম পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন পণ্য বিপণন পদ্ধতি । বিভিন্ন জিনিসের উচ্চমূল্য পেতে ২ হাজার বছরেরও আগে থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই পদ্ধতি । খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ সালে ব্যাবিলনে প্রথম নিলাম হয়েছিল বলে ধারণা করা হয় । চলতি বাজারজাত দ্রব্য থেকে শুরু করে প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত অধুনালুপ্ত সব রকমের জিনিসেরই নিলামে বিক্রি হওয়ার নিদর্শন আছে । লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির শিল্পকর্ম থেকে মেরিলিন মনরোর ব্যবহার্য পোশাক--কোনও কিছুই এর ব্যতিক্রম নয় ।
সাহিত্যেও বহু বিখ্যাত লেখক-কবির পাণ্ডুলিপি বা হাতে লেখা চিঠি সারা পৃথিবীতেই নিলাম হয় । যেমন একটি নোটবইয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের বারোখানি কবিতা আর বারোখানি গান যখন উদ্ধার হয়েছিল, আমরা সকলেই জানি, অনিবার্যভাবেই তা নিলামে উঠেছিল । এই নোটবইটি রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ এর দশকে তাঁর ঘনিষ্ঠ কোনও পরিবারকে উপহার দিয়েছিলেন । ১৯২৮-এ লেখা এই গান এবং কবিতাগুলির সব কটিই পরিবর্তিত রূপে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়েছিল । সে যাই হোক, নিলামে ওঠা নোটবইটি তো রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতে লেখা ! সেই অননুকরণীয় কাটাকুটির শিল্পিত চিত্র সমেত ! সুতরাং দাম তো উঠবেই, এতে আর আশ্চর্যের কী আছে ! কিন্তু একখানা আস্ত ছাপা বই, যেখানে লেখক বা শিল্পীর হস্তাক্ষরের চিহ্নমাত্রও নেই, বা কোনও বিখ্যাত মানুষের স্পর্শের কোনও ইতিহাসও নেই, যদি কখনও নিলামে ওঠে ? শুনেছেন কখনও ? ওঠা সম্ভব ? হয় এ রকম ?

হয় । কিন্তু সে কথায় আসার আগে একটা অন্য গল্প বলি । স্যার আইজ্যাক অ্যাসিমভের একটি ভারী মজার গল্প মনে পড়ে গেল এই মুহূর্তে । লেখকের ওই কল্পবিজ্ঞানের গল্পে একটি অদ্ভুত বইয়ের খবর আছে । গল্পটি ২১৫৫ সালের ১৭ মে'র গল্প ! ওই দিন গল্পের মুখ্য চরিত্র মার্গি, বছর দশেকের একটি মেয়ে, তার দিনপঞ্জিতে লিখছে, তার বন্ধু টম একটি বই খুঁজে পেয়েছে । বই বস্তুটি তাদের কাছে ভীষণ আশ্চর্যের, কারণ তারা সকলেই কম্পিউটারে পড়াশোনা করে । টেলিভিশনের পর্দায় প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি লাইন, প্রতিটি পাতা নড়াচড়া করে । এভাবেই হাজার হাজার পাতা পড়া হয়ে যায় কারণ, পাতারা সরে সরে যায় । তাই টমির বাড়ির চিলেকোঠা থেকে উদ্ধার হওয়া বিবর্ণ হলদে রঙের স্থবির অক্ষরমালায় সাজানো বইখানি তাদের কাছে যুগপৎ বিস্ময় ও কৌতূহলের বিষয় । বইটি আসলে টমির ঠাকুরদার আমলের । সে সময়ের বিদ্যালয়জীবন কেমন ছিল, এ সবই লেখা আছে বইতে । যেহেতু ২১৫৫ সালে বই বলে কোনও বস্তু থাকবে না পৃথিবীতে, অন্তত লেখকের অনুমান তেমনটাই, তাই আশ্চর্য বস্তুটি নিয়ে মার্গি আর টমির গবেষণার অন্ত নেই ।
২১৫৫ সালে বইটি সত্যিই নিলামে উঠবে কি না ভবিষ্যৎ বলবে, এ বিষয়ে অর্থহীন তর্কাতর্কি অনভিপ্রেত । কিন্তু আজও তো বই নিলামে উঠছে ! হ্যাঁ, আস্ত ছাপা একখানা বই, যেখানে কোনও জনপ্রিয় (বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত) মানুষের সই-সাবুদ বা ওই জাতীয় কোনও প্রামাণ্য হস্তলিপি বা তাঁর স্পর্শের অতীত নিদর্শনও নেই । এই নজির সৃষ্টিকারী বইটি হল 'ইংলিশ টেক্সটবুক থিয়োরি ফর কলেজেস অ্যান্ড হাই স্কুলস' । বইটি অবশ্য মূল জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনূদিত । প্রকাশকাল ১৯৪০-এর দশক ।

এই জার্মান স্কুলপাঠ্য বইটিতে অ্যাডলফ হিটলারকে শান্তির দূত হিসেবে দেখানো হয়েছে । আর ব্রিটিশদের বলা হয়েছে যুদ্ধবাজ । বইটিতে নাৎসি জামানার প্রশংসা করে ব্রিটিশদের অত্যাচারের কাহিনিকে ফলাও করে তুলে ধরা হয়েছে । এমনকী, ভারতবর্ষেও ইংরেজ শাসকদের নিপীড়নের ইতিহাস এ বইয়ে বর্ণিত হয়েছে । উদ্দেশ্য, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের মগজে যুদ্ধবাজ ব্রিটিশ-চরিত্র সম্পর্কে যত বেশি সম্ভব তথ্য ইমপুট করা ! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে স্কুলপাঠ্য এ বইয়ে হিটলারকে মহান প্রমাণ করতে তাঁর শেক্সপিয়র প্রীতি নিয়েও অনেক অবাস্তব বাক্য খরচ করা হয়েছে । শেক্সপিয়রের জন্মস্থানের ছবিও ছাপানো হয়েছে বইটির প্রচ্ছদে ।
আসলে চল্লিশের দশকে, ইতিহাসবিদরা বলছেন, ইংল্যান্ডে হামলার ছক কষেছিল জার্মানি । তার আগে-আগেই এ বইটি পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত করে জার্মান শিশুমনে হিটলার ও ব্রিটেন সম্পর্কে যথাক্রমে গভীর শ্রদ্ধা ও বিজাতীয় ঘৃণার বীজ বপন করার একটা সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল । যদিও এই হামলার পরিকল্পনা পরবর্তীতে আর বাস্তবায়িত হয়নি । তা ছাড়া নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের যে ভয়াবহতা, খুব সচেতনভাবেই, এ বইয়ে তার বিন্দুবিসর্গও উল্লিখিত হয়নি ।
সমগ্র ইউরোপে যখন নাৎসি বাহিনীর দাপট সে সময়ে লেখা, এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমসময়ে স্কুলপাঠ্য, এই বইটির একটি মাত্র কপি এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে উদ্ধার হয়েছিল এক সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে, অনেকটা অ্যাসিমভের পূর্বোল্লেখিত মজার গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র ছোট্ট টমির দাদুর বাড়ির চিলেকোঠা থেকে সে আমলের পরিত্যক্ত হলুদ হয়ে যাওয়া বইটির হঠাৎ আবিষ্কৃত হওয়ার মতন । টমির বইটিকে নিলামে তুলতে আরও বহু সময় অপেক্ষা করতে হবে আমাদের, পৃথিবী থেকে নিঃশেষিত হয়ে যেতে হবে বই নামের বস্তুটি--তবুও মানুষকে বেঁচে থাকতে হবে, ভাবুন--শুধু তাই নয়, ভূত দেখার মতো একদিন মানুষকে চমকে উঠতে হবে বই দেখে--ভগবান করুন, সে দিন যেন না আসে--কিন্তু অতি তুচ্ছ একটি স্কুলপাঠ্য বই, যা কিনা প্রবল মিথ্যাচার আর প্রবলতর মোসাহেবিতে ঠাসা, যেখানে না আছে হিটলারের হস্তাক্ষর, না তাঁর স্পর্শ, চড়া দামে নিলামে উঠে সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে, নিলাম নিজেই বড় সস্তা, বড় সুলভ !
(ছবিঋণ : উইকিপিডিয়া, ঢাকা টাইমস ।)



Comments