top of page
Search

বিশ্ব পরিবেশ দিবস : গাছ ও মানুষ



(আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস । যে মানুষ গাছকে ভালবাসতে জানেন না, গাছের মর্ম বোঝেন না, গাছকে পড়তে শেখার হাতেখড়ি হোক আজ তাঁর । প্রকৃতার্থেই আজ গাছকে ভালবাসতে শেখার দিন ।)


ree

রাস্কিন বন্ডকে কমবেশি সকল শিক্ষিত ভারতীয়ই চেনেন । এমনকী, যাঁরা তথাকথিত ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নন, 'জুনুন' চলচ্চিত্রের দৌলতে তাঁরাও বন্ডকে চিনে নিয়েছেন । কারণ, ওই ছবিটি তাঁরই লেখা বিখ্যাত উপন্যাস 'ফ্লাইট অফ পিজিয়নে'রই চিত্ররূপ । তাঁর লেখা বিখ্যাত ছোটগল্প 'দ্য চেরি ট্রি'তে গাছের সঙ্গে মানুষ কেমন নিবিড় ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, যেতে পারে, তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা পাওয়া যায় । গাছকে ভালবেসে মানুষ কীভাবে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে, এ গল্প না-পড়লে অজানাই থেকে যায় ।


ree

হিমালয়ের তরাই অঞ্চলে রাকেশ তার দাদুর সঙ্গে বসবাস করে । সেখানে গাছ-গাছালি খুবই কম, কারণ পাথুরে মাটি আর হিম ঝরা বাতাস গাছের বৃদ্ধিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় । লেখক নিজেও হিমালয়ের পাদদেশে একটা ছোট্ট শহরে জন্মেছিলেন । ফলে ওই অঞ্চলের জীবনাভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি সম্যক অবহিত ছিলেন । সে যাই হোক, গল্পের শুরুটা এ রকম, একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে রাকেশ ৫০ পয়সার চেরি ফল কিনে খেতে খেতে যখন বাড়ির কাছাকাছি এসে পৌঁছল, তখন তার হাতে আর তিনখানা মাত্র ফল অবশিষ্ট । দাদুকে একখানা দিয়ে বাকি দুটো সে নিজের মুখে পুরে নিল, এবং শেষ ফলের আঁটিটা মুখ থেকে বের করে হাতের তালুতে রেখে যখন সে দাদুকে জিজ্ঞেস করল, "দাদু, চেরি বীজ কি ভাগ্য ফেরায় ?" তখন দাদু তাকে সেটা মাটিতে পুঁতে ফেলার পরামর্শ দিলেন ।


এর পর বীজের অঙ্কুরিত হওয়া ও বহু প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ছোট্ট গাছটির বড় হবার রোমাঞ্চকর কাহিনি ! ছাগলে আক্রমণ, ঘাসুড়ের কাস্তে কিংবা শুয়োপোকার ভোজ যতবারই তাকে মৃত্যুমুখে পতিত করেছে, ততবারই রাকেশ আপনজনের মতো গভীর মমতা-সেবা-পরিচর্যায় তাকে সুস্থ করে তুলেছে । জীবনাকাঙ্ক্ষী করে তুলেছে । আর গাছটাও যেন গভীর ভালবাসায় বরণ করে নিয়েছে রাকেশকে । আবেগের এই পারস্পরিক আদানপ্রদান, উদ্ভিদের সঙ্গে প্রাণীর, এত সংযত তারে বাঁধা, এত সংহতরূপে সাজানো, এত নিপুণ তুলিতে আঁকা, যে না-পড়লে প্রকৃত রসাস্বাদন সম্ভব নয় ।


ree

যাই হোক, একদিন সকালে গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে রাকেশকে ডাকছেন দাদু, "রাকেশ দেখে যা !" কী দেখবে রাকেশ ? রাকেশ দেখবে, চেরি গাছটার ডালের এক প্রান্তে একটা হালকা গোলাপি রঙের কুঁড়ি এসেছে । রাকেশ নির্বাক, স্তব্ধ ! কিছুক্ষণ পরে সে বলল, "জঙ্গলে এত গাছ, তবু এই গাছটাকেই আমরা এত ভালবাসি কেন দাদু ?"

"কারণ আমরা গাছটা লাগিয়েছি !" এর পর গাছটার সারা গা পরম মমতায় স্পর্শ করে রাকেশ । হাত বোলায় তার মসৃণ বলকলে, কাণ্ডের গোড়া থেকে পাতার শীর্ষবিন্দু পর্যন্ত । এই অনুভূতির কোনও ব্যাখ্যা হয় না, এই প্রাপ্তির কোনও বিশ্লেষণ হয় না, সে শুধু স্বগতোক্তি করে, "এই-ই কি ঈশ্বরকে পাওয়ার অনুভূতি ?"


ree

এই ঈশ্বরকে পাওয়ার অনুভূতি কিন্তু রাস্কিন বন্ডের গল্পের পাতাতেই আটকে নেই আজ আর । গ্রীষ্মের কঠোর তাপপ্রবাহের প্রতাপ উপেক্ষা করে এই কলমচির উপস্থিতিতে আলিপুর হর্টিকালচার সোসাইটি সে দিন প্রত্যক্ষ করল বাস্তবের গাছ-মানুষের নিবিড় সম্পর্কের বন্ধনে মানুষের ঈশ্বরপ্রাপ্তির অনুভূতি ! কলকাতার সবুজায়নের লক্ষ্যে মেয়র পারিষদ (উদ্যান)-এর উদ্যোগে কলকাতা পুরসভার কোনও পরিবারে শিশু জন্মগ্রহণ করলেই সেই পরিবারের হাতে একটি গাছের চারা তুলে দেওয়ার অভিনব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল একবার, আপনারা জানেন । আমি জানি না সেই পরিকল্পনার সূত্র ধরেই, না কি অন্য কোনও, পরিবারে এক নতুন সদস্যের আগমনের দিনে শিশুটির দাদু ও ঠাকুমা আলিপুর হর্টিকালচারে এসে নাতির নামে রোপণ করে গেলেন চারাগাছ । শুধু এঁরাই নন, সে দিন আরও এক ভদ্রলোক, মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখলাম, বাবা হওয়ার দিনেই, এখানে নিজের হাতে লাগানো চারা গাছের ফলকে নিজের মেয়ের নাম দেখে ঈশ্বরপ্রাপ্তির অনুভূতি লাভ করে গেলেন ।


এই যে মানুষের নামে চারাগাছ পুঁতে অভিনব জন্মদিন উদযাপন, এ কিন্তু শুধুই প্রতীকী নয় ! এর ইমোশ্যনাল এফেক্টও অসাধারণ ! গাছ আর মানুষ একসঙ্গে বেড়ে উঠবে পাশাপাশি, তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অনুভব করবে গাছকে, আর গাছও যে তাকে অনুভব করছে, এই অনুভব জন্মাবে মানুষের ভেতর । তারপর মানুষ বড় হয়ে, পড়ালেখার কারণে বা কর্মসূত্রে, যখন বাইরে যাবে, পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে গাছও টানবে তাকে, "আয়, ফিরে আয় !" তার প্রত্যাবর্তনের ইতিহাসে লেখা থাকবে গাছের হাতছানি ! গাছ মানুষকে ডাকছে ! মানুষ সেই ডাক উপেক্ষা করতে পারছে না । সে ফিরে আসছে । এখানেই তো সভ্যতার জয় ! আবিশ্ব সবুজ ধ্বংস করে বাস্তবিকই সভ্যতা যেতে বসেছে পতনের দিকে, মৃত্যুর দিকে । এমন এক সংকট মুহূর্তে মৃত্যু পথযাত্রী উন্মার্গগামী মানুষের এই প্রত্যাবর্তন আসলে মৃত্যুমুখ থেকে জীবনাভিমুখে সভ্যতারই প্রত্যাবর্তন ! প্রকৃতার্থেই এ প্রত্যাবর্তন ঈশ্বরলাভের !

 
 
 

Comments


bottom of page