বিশ্ব বই দিবস : বই পড়া
- rajatsubhrablog
- Apr 23, 2023
- 6 min read
(আজ বই দিবস । ১৯৯৫ সালের ২৩ এপ্রিল ইউনেস্কো প্রথমবারের মতো বিশ্ব বই দিবস উপযাপন করে । এর পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর ২৩ এপ্রিল দিনটি বিশ্ব বই দিবস হিসেবে পালিত হয় ।)

এ কথা আমরা সকলেই জানি এবং মানি, বই পড়ার কোনও বিকল্প নেই । বই না-পড়া অন্ধকার সমার্থক । অন্ধতা নিবারণের জন্য তাই বই পড়তেই হবে । ইদানীং মানুষের বই পড়া কমে গিয়েছে বলে যাঁরা চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করছেন, আমি ঠিক তাঁদের দলের নই । বই পড়া যদি সত্যিই কমে যেত, বইয়ের উৎপাদন কি এত বৃদ্ধি পেত ? প্রকাশকরা কি লোকসান করার জন্য বই বানাচ্ছেন, নাকি নগরে, জেলায়, মহকুমায় মায় মফসসলের বুকেও এই যে এত এত বইমেলা হচ্ছে বছরভর, সে কি শুধুই ফুচকা আর পাপড়ি চাট বিক্রির জন্য ? বই পড়া তাই অবশ্যই বেড়েছে, পরিসংখ্যান সে কথাই বলছে ।
কিন্তু এর মানে এই নয় যে, বই পড়ে অধিকতর মানুষের মেধা ও মনন সমৃদ্ধতর হচ্ছে আজ । আর এখানেই অনিবার্যভাবে যে প্রশ্নটি এসে পড়ে, আমাদের বই পড়া কি তা হলে সার্থক বা সাফল্যমণ্ডিত হচ্ছে না ? কেন হচ্ছে না ? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বই পড়ার তিনটি স্তর বা পর্ব আছে । এই তিনটি স্তর বা পর্বের সাফল্যের ওপরেই একটি বই পড়ার বৃত্ত সম্পূর্ণতা লাভ করে । একটু বিশদে বিষয়টি আলোচনা করার প্রয়োজন আছে । প্রথম স্তর বা পর্বটি হল, বই নির্বাচন বা সিলেকশন অব দ্য বুক । এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তর, কারণ এই স্তরের সাফল্যের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে পরবর্তী স্তরগুলোর ভবিষ্যৎ, ঠিক যেমন মজবুত ভিতের ওপর বাড়ির ফ্লোরগুলো দাঁড়িয়ে থাকে । এখন এই নির্বাচন কীভাবে করতে হবে, সে হল লাখ টাকার প্রশ্ন ! একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি । ধরা যাক এই মুহূর্তে আমার আগ্রহের বিষয় কাদম্বরী দেবী । বাজারে হাজার একটা বই পাওয়া যায় এই বিষয়ের ওপর । এই অজস্র বইয়ের সম্ভার থেকেই আমাকে সঠিক বইটি নির্বাচন করতে হবে । এই নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখা, সমাজ মাধ্যমে বইয়ের আলোচনা পড়া ইত্যাদি জনপ্রিয় কিছু পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া অযৌক্তিক নয়, কিন্তু এই যৌক্তিকতার ওপর অতি নির্ভরশীলতা, মাথায় রাখতে হবে, যেন আমাকে বিভ্রান্তির পথে চালিত না করে । দিনের শেষে আমি কিন্তু কাদম্বরী দেবীর সম্পর্কেই জানতে চাই, তাঁকে নিয়ে কোনও মুখরোচক আষাঢ়ে গল্প নয় । কিন্তু বইটি হাতে আসার পর যদি অনাকাঙ্ক্ষিতটিই সত্যি হয়ে দাঁড়ায়, বলা বাহুল্য, সে বই আর পড়া হয়ে ওঠে না । অর্থাৎ প্রথম স্তরেই আমার বই পড়া ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল । আর যদি বই নির্বাচন সঠিক হয়ও, সে ক্ষেত্রেও, আমার বই পড়া চূড়ান্ত সাফল্যের মুখ দেখবে কি না, তা নিরূপণ করতে পরবর্তী স্তরগুলির মুখাপেক্ষী হতেই হবে ।

দ্বিতীয় বা মাঝের স্তরটি হল, বইটি পাঠের পর অন্তরে বইটির গ্রহণযোগ্যতা বা অ্যাকসেপ্টেবিলিটি অব দ্য বুক । একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উদাহরণ সহযোগে বিষয়টি তরলীকৃত করার চেষ্টা করছি । খুব সম্প্রতি একটি খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্থা থেকে আমার এক অগ্রজপ্রতিম বন্ধু-লেখকের একটি বই আমি আনিয়ে নিই কিছুটা বিজ্ঞাপনের চমকে, কিছুটা বিষয়ের আকর্ষণে, কিছুটা বা বন্ধুত্বের কারণে । এই স্বনির্বাচিত বইটি অনেক প্রত্যাশা নিয়ে পড়েও ফেলি দ্রুত । কিন্তু, কী আশ্চর্য, বইটি পড়তে পড়তেই আমি যুগপৎ প্রতারিত ও হতাশাগ্রস্ত বোধ করতে থাকি । প্রথমত, কী ধরনের প্রতারণা ? না বইটি একটি সম্পাদনা কর্ম--রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথের কিছু চিঠিপত্তরের সংকলন--বিশ্বভারতীর আশ্রমিক অধ্যাপক নির্মল কুমার চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরাকে লেখা রথী ঠাকুরের চিঠি ! অথচ বইটির মলাটে, ব্ল্যার্বে বা বিজ্ঞাপনে কোথাও 'সম্পাদনা' শব্দটির উল্লেখ নেই; বইটিকে পুরোপুরি লেখকের মৌলিক কর্ম বলে দেখানো হয়েছে । দ্বিতীয়ত, কী ধরনের হতাশা ? বইটি আদ্যোপান্ত পাঠ করে আমার এই প্রতীতি জন্মেছে, সম্পাদকের এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য এখানে রথী ঠাকুরের সঙ্গে মীরা দেবীর অবৈধ প্রণয় সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা করা ! খুব স্বাভাবিকভাবেই হতাশায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত আমার অন্তরাত্মা বারবার আর্ত প্রশ্ন তুলেছে, এই একান্ত ব্যক্তিগত চিঠিপত্রগুলো ফাঁস করে একটি পরিবারের সম্মানকে ভাবিকালের কাছে এইভাবে কালিমালিপ্ত করার চেয়ে, রথীন্দ্রনাথের জীবন ও কাজের অনেক অনালোকিত ও স্বল্পালোকিত দিকের ওপর সমূহ আলো ফেলে পাঠকের বৃহত্তর স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা কি আদৌ করা যেত না ? আমার অসহিষ্ণু মন আরও প্রশ্ন তুলেছে, এই চিঠিগুলোর স্বত্ব কার ? কে এই সম্পাদককে এগুলি প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন ? যিনিই দিয়েছেন, তাঁর অধিকার আছে তো এ সম্মতি দানের ? আমি নীতিসংগত ও আইনসংগত উভয় অধিকারেরই প্রশ্ন তুলছি । এই বই তাই আপনিই আমার অন্তর হতে দূরে রইল, আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হয়ে উঠতে পারল না । ফলে অন্তরে বইটির গ্রহণযোগ্যতা বা অ্যাকসেপ্টিবিলিটি অব দ্য বুক এই পর্যায়ে আমার বই পড়াটি ব্যর্থ ও অসফল হয়ে গেল ।
কিন্তু যে বই পড়া এই দ্বিতীয় তথা মাঝের স্তরটিও সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হতে পারবে, তার বৃত্তকে সম্পূর্ণতা পেতে হলে পরবর্তী তথা তৃতীয় বা সর্বশেষ স্তরের সাফল্যের ওপর তাকে নির্ভরশীল হতে হবে । এই তৃতীয় তথা সর্বশেষ স্তরটি হল, পাঠকের সামাজিক, মানসিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, আর্থিক, পরমার্থিক বা ব্যবহারিক জীবনে বইটির উপযোগিতা বা ইউটিলিটি অব দ্য বুক । এখানেও একটি উদাহরণ সহযোগে বিষয়টি আলোচনা করলে তা সহজবোধ্য হয়ে উঠবে মনে হয় । আমার এক অতি সাধারণ ছাপোষা কেরানি বন্ধুর গল্প, যে কাজ করে একটি সরকারি আপিসে । কিন্তু তার অসাধারণত্ব হল এই, সে এক দুর্ধর্ষ পাঠক । বই পড়ায় তার ক্লান্তি নেই । এইবার হয়েছে কী, আপিসের কাজে সে একবার এক সপ্তাহের ছুটি পেয়েছে, মানে, যাকে বলে অন ডিউটি আর কী ! কাজটা খুব সামান্য, দু'দিনেই সে সেরে ফেলতে পারে, কিন্তু অনেক চেষ্টাচরিত্র করে ছুটিটা ছ'দিনের করাতে পেরেছে । এর জন্য অবিশ্যি সহকর্মীদের ঈর্ষা মিশ্রিত ট্যারা কথাও হজম করতে হয়েছে তাকে । সে যাক গে, তার উদ্দেশ্য তো সিদ্ধ হয়েছে ! কী উদ্দেশ্য ? না দু'দিনেই কাজটা সেরে, বাকি পাঁচটা দিন বউ-বাচ্চা নিয়ে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসা, যাকে বলে ছোটখাটো একটা ট্রিপ আর কী !

যাই হোক, অনেক রাত্রি অবধি বই পড়া বন্ধুটির অভ্যেস । বই পড়তে পড়তে বুকের ওপর বইটি রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে সে । এখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে, একজন ভীষণ মুখচেনা ভদ্রলোক তাঁর পিঠে টোকা মেরে বলছেন, "ভাল আছেন ?" বন্ধুটি চিনতে পারছে না তাকে, আবার সে কথা স্বীকার করতেও লজ্জা বোধ করছে । সে দেঁতো হাসি হেসে বলছে, "আছি এক রকম, আপনি ?"
"আরে মশাই, আপনারা তো রাজার হালে আছেন, আমাদের কেমন দিন কেটেছে জানেন ?"
"কী রকম ?"
"সেই ১৪ বছর বয়সে চাকরিতে ঢুকেছি । সারা দিনে টানা ৯ ঘণ্টা ডিউটি করতে হত । মশাই বন্যপ্রাণী বোঝেন ? হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই বন্যপ্রাণীকে খাঁচায় পুরে দিলে তার যে অবস্থা হয়, আমারও তাই হয়েছিল..."
"অদ্ভুত !"
"ছুটি ? আপনাদের তো ছুটির শেষ নেই । আমরা কটা ছুটি পেতাম জানেন ? একটা ইস্টার ডে'র, একটা বড়দিনের, আর গ্রীষ্মের সাতটা । এ ছাড়া রোববারগুলো । ব্যস । তাও রোববারের বন্ধ দোকানপাটগুলো যেন জানিয়ে দিত, কেনাকাটার আনন্দ তোমাদের জন্য নয় । গ্রীষ্মের ছুটিতে চলে যেতাম হার্টফোর্ডশায়ারে, আত্মীয় বাড়িতে । কী আনন্দেই না দিনগুলো ফুরিয়ে যেত ! আবার হাসিমুখে কাজে লেগে যেতাম এই ছুটিটারই প্রত্যাশায় আরও একটা বছরের জন্য ।"
"দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনার নামটা আমার ভীষণ পরিচিত কিন্তু কিছুতেই..."
"কী কষ্টে যে ৩৬ টা বছরের কর্মজীবন কাটিয়েছি, কল্পনাও করতে পারবেন না । মশাই ফরাসি বিপ্লবের সময় ১৭৮৯-এর জুলাই মাসে বাস্তিলের জেল ভেঙে আমৃত্যুবন্দি নিরপরাধ মানুষগুলোকে যখন বের করে আনা হয়েছিল, তখন তাদের কেমন অবস্থা হয়েছিল জানেন ? হ্যাঁ, আমি ঠিকই বলছি, অবসরে পরে আমার অবস্থাও হয়েছিল ওই রকম ," ভদ্রলোক একটানা কথাগুলো বলে চুপ করলেন ।

এর পর সকাল আটটার ঘণ্টায় বন্ধুর ঘুম ভেঙে যায় । ও দ্যাখে, বুকের ওপর 'এসেজ অব এলিয়া' এলিয়ে পড়ে আছে । বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজ প্রাবন্ধিক চার্লস ল্যাম্বের আত্মজৈবনিক প্রবন্ধের সংকলন 'এসেজ অব এলিয়া' আমার বন্ধুর চিন্তাচেতনাটিকেই বদলে দিয়েছিল সে দিন ।
এই কিংবদন্তি লেখক সে দিন স্বপ্নে হাজির হয়ে কী অসাধ্য সাধন করেছিলেন জানেন ? আমার বন্ধু দু'দিনেই কাজটা সেরে তৃতীয় দিনে অফিস জয়েন করেছিল, আর স্বগতোক্তি করেছিল, "হায়, পোড়া বাংলার সব সরকারি- আধা সরকারি কর্মীরা যদি চার্লস ল্যাম্ব পড়তেন !" পাঠক নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন, আমার বন্ধুর বই পড়া তার তৃতীয় তথা সর্বশেষ স্তরের চূড়ান্ত সাফল্য কীভাবে লাভ করল তা হাতে-কলমে দেখানোর জন্যই এত কথা বলা !
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বই বিক্রি বাড়লেই মানুষের মেধা ও মননের উৎকর্ষ বাড়বে, এমনতরো নিশ্চয়তা নেই । এক দিকে যেমন প্রকাশক অহরহ নির্মাণ করে চলেছেন অসংখ্য অন্তঃসারশূন্য অযোগ্য বই, অন্য দিকে তেমনি পাঠক ঘর বোঝাই করে ফেলছেন যে বিপুল সংখ্যক বইয়ে, তার মধ্যে অতি নগণ্য মুষ্টিমেয় যে কটি বই সত্যিই যথার্থ যোগ্য ও গুণসম্পন্ন, সেগুলো হয়তো সেই পাঠক নিছক আলমারির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যই কিনেছেন । আবার 'অনন্ত নক্ষত্রবিথী' যে পাঠক নিভৃতে খুঁজে চলেছেন তাঁর অভীপ্সার বই, তাঁর বই পড়াও কখনও-সখনও, হয়তো--হয়তো কেন, নিশ্চিতই--ওই ত্রিস্তরীয় প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে, ব্যর্থতায় মুখ থুবড়ে পড়ছে । প্রখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক স্যার ফ্রান্সিস বেকনের একটি উদ্ধৃতি এখানে তুলে ধরা খুব যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে করছি, "Some books are to be tasted, others to be swallowed, and some few to be chewed and digested !" তো আমাদের বই পড়া এই ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থার সাফল্যের মধ্যে দিয়ে যতটুকুই সত্যি সত্যি 'ডাইজেস্টেট' হতে থাকবে, মানুষের মেধা ও মননের উৎকর্ষ বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজ ততটুকুই উন্নততর দৃষ্টিশক্তির অধিকারী হয়ে উঠবে বলে আমি বিশ্বাস করি ।



Comments