top of page
Search

মানবাধিকার--চিন ও ভারত : একটি তুলনামূলক আলোচনা




(১০ ডিসেম্বর দিনটিকে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সব দেশ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালন করে । বলা বাহুল্য, আমরাও তার ব্যতিক্রম নই ।)


ree

ঘটনা ১: গত শতাব্দীর শেষের দিকে বিশিষ্ট চিনা পদার্থবিদ ফ্যাং লিঝির ওপর অমানবিক রাষ্ট্রীয় নির্যাতন হয়েছিল, আমরা সবাই জানি । গণতন্ত্রের তীব্র সমর্থক এই পদার্থবিদের একটি লেখা 'দ্য চাইনিজ অ্যামনেশিয়া'য় ওই দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ ছবি ফুটে ওঠে । স্বাভাবিকভাবেই কমিউনিস্ট চিন সরকারের 'মোস্ট ওয়ান্টেড' তালিকায় চলে আসেন তিনি । শেষ অবধি সস্ত্রীক ফ্যাং বেজিংয়ের মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় চেয়ে অ্যাসাইলাম পান । সেখানে এক বছর কাটিয়ে শেষমেশ আমেরিকায় চলে আসেন ওই দম্পতি । আর কোনও দিন দেশে ফিরতে পারেননি তাঁরা ।


ঘটনা ২: বিশিষ্ট চিনা শিল্পী আই উইউই সরকারের আর্থিক দুর্নীতি ফাঁস করে টুইটারে জনমত তৈরি করে ২০১১-তে গ্রেফতার হয়েছিলেন । তাঁর মুক্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সারা বিশ্ব । শেষ পর্যন্ত তাঁকে জামিনে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল সরকার । ৮০ দিন কারাবাসের পর মুক্তি পেয়েছিলেন খ্যাতিমান শিল্পী । তার পরই জানা যায়, বকেয়া কর আর তার ওপর জরিমানা মিলিয়ে উইউইয়ের ‘ফাইন’ এক কোটি কুড়ি লক্ষ ইউয়ান, মানে প্রায় কুড়ি লক্ষ ডলার । সকলেই একমত, সরকারের এই চাল আসলে উইউইকে হেনস্থার জন্য ।


ঘটনা ৩: চেন গুয়াং চেং । ছোটবেলা থেকেই তিনি অন্ধ । তবু পড়ালেখা করেছেন, বড় হয়েছেন । কিন্তু রাষ্ট্রের মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে লড়াই না করে পারেননি । প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁর মতো অজস্র গরিব প্রতিবন্ধীদের প্রতি রাষ্ট্রের বিমাতৃসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ করেছিলেন পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ করেছিলেন রাষ্ট্রের এক সন্তান নীতির নির্মম প্রয়োগের লক্ষ্যে সরকারি কর্তাদের ভয়াবহ অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে । বিপুল জনসমর্থন পেয়েছিলেন তিনি । ভয়ে পিপলস রিপাবলিকের ভিত নড়ে গিয়েছিল । শানডং প্রশাসন তাই বিনা বিচারে জেলে পুরে দিয়েছিল তাঁকে ২০০৬-এ । ২০১০-এ যখন ছাড়া পেলেন, আবার গৃহবন্দী তিনি । অথচ, কী আশ্চর্য, কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগই ছিল না তাঁর বিরুদ্ধে । নিরপরাধ নাগরিক, অথচ অবরুদ্ধ ।  তারপর ২০১২-এর ২২ এপ্রিল অন্ধকার রাতে বন্দুকধারী রক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন তিনি । অন্ধ পলাতক চেন অনেক লড়াই করে জীবন মৃত্যুর দোলাচলে অবশেষে এসে পৌছলেন বেজিংয়ের মার্কিন দূতাবাসে । খবর ছড়িয়ে পড়ল--গৃহবন্দি চেন পালিয়েছেন । দূতাবাসে ছ'দিন কাটল তাঁর । দুটি দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করল । চিন দেশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার হরণের যে-অভিযোগে সব থেকে বেশি সরব হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সেই অভিযোগেরই অকাট্য প্রমাণ হাতে পেয়ে তারা কোণঠাসা করতে শুরু করল চিনকে । চেনও অনভিজ্ঞ । তিনি বলে বসলেন, দেশ ছেড়ে তিনি যেতে চান না । ইতিমধ্যে হিলারি পৌঁছলেন সে দেশে । মার্কিন মধ্যস্থতায় বেজিংয়েই চেনের থাকার ও পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে সম্মত হল সরকার । বাড়ি থেকে পালানোর সময়ে তাঁর পা ভেঙে যাওয়ায়, চিকিৎসা করতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল চাওয়্যা‍ং হসপিটালে । এত দূর পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু সেখানে গিয়ে বিশ্বরূপ দেখলেন চেন । হসপিটালের ঘরে স্ত্রী জানালেন, জিজ্ঞাসাবাদের নামে শানডংয়ের পুলিশ অত্যাচার করেছে তাঁর ওপরেও, মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে তাঁকে ও তাঁদের ছেলেমেয়েকে । কয়েক ঘণ্টার অভিজ্ঞতায় চেন বৃদ্ধ হয়ে গেলেন । তিনি বুঝতে পারলেন, পালানোই শ্রেয় । সরকার তখনই হয়তো তাঁকে কিছু করবে না, কিন্তু প্রচারের আলো সরে গেলে, ভয়াবহ শাস্তি নেমে আসবে তাঁর ওপর । আসবেই । তীব্র প্রতিহিংসাপরায়ণ রাষ্ট্র তাঁকে বাঁচতে দেবে না, বাঁচতে দেবে না তাঁর স্ত্রী-সন্তানদেরও । তাই নিজে বাঁচতে গেলে, পরিবারকে বাঁচাতে গেলে, পালানো ছাড়া উপায় নেই । তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন দেশ ছাড়ার । বেজিং কনসুলেট এবং সেখান থেকে সরাসরি ওয়াশিংটন জেনে নিল তাঁর ইচ্ছা--"আই ওয়ান্ট টু গো টু আমেরিকা" । মার্কিন প্রেসিডেন্টের ফোন এল সে দেশ থেকে--আমেরিকা তাঁকে আশ্রয় দিতে রাজি ।


ree

হ্যাঁ, কোনও সন্দেহ নেই, রাষ্ট্রের মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আর মানবাধিকার হরণের অভিযোগ সব থেকে বেশি শোনা যায় চিনদেশের বিরুদ্ধেই । সে দেশের এই অতিনিয়ন্ত্রণ ও মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে শুধু আমেরিকা কেন, পৃথিবীর অনেক দেশই সোচ্চার ।এমনকী, আমরাও খুব পিছিয়ে নেই এ ব্যাপারে । অনেক বড় বড় কথা আমরা বলেছি, বলি । কিন্তু একটা বিষয় ভেবে দেখা এখানে জরুরি বলে মনে হয়, আমরাও কি মানবাধিকার হরণে খুব বেশি পিছিয়ে আছি সে দেশের থেকে ? বরং সে দেশে তো অনেক প্রতিবাদ হয় ভেতরে ভেতরে; অত্যাচারের মাত্রা যত বাড়ে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুনও তত জ্বলতে থাকে ধিকিধিকি । আর আমরা ? প্রতিবাদ করতে জানি আমরা ? প্রতিবাদ হয় আমাদের দেশে ? প্রতিবাদ করলেই জুটবে দেশদ্রোহীর তকমা--এই ভয়ে আমরা চোখকান বন্ধ করে বসে থাকি, মুখ বুজে মেনে নিই মানবতার অপমান । চিনের সমালোচনা করার আগে নিজেদের দিকে একবার তাকাব না ? আয়নায় দেখব না একবার ভীরু কাপুরুষের অবয়ব ? আরেকটু দায়িত্ববান কি হতে পারি না আমরা ? আরেকটু সংবেদনশীল ? মানবাধিকার হরণের একশো একটা উদাহরণ খাড়া করে এ লেখার পরিসর কিংবা আমার বিরূদ্ধে অভিযোগের ব্যাপ্তি কোনওটিই আড়ে-দিঘে বাড়ানোর বাসনা এই মুহূর্তে আমার নেই, পরিবর্তে একটি ছোট্ট আপাত নিরীহ অরাজনৈতিক ঘটনার উল্লেখ করতে চাই শুধু ।


ree

২০১০-এর জুলাই মাসে চিনেরই বাসিন্দা জি পিং লি-কে আমরা গ্রেফতার করেছিলাম । অভিযোগ, ভিসার মেয়াদ ফুরোনোর পরেও তিনি ভারতে রয়েছেন । তিনি নেপাল থেকে খড়িবাড়ি হয়ে গ্যাংটক যাচ্ছিলেন । খড়িবাড়ির বাসে তল্লাশি চালানোর সময়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে । ভাল কথা । শিলিগুড়ির আদালত তাঁকে ১৪ দিনের জেল হেফাজত দেয় । আরও ভাল কথা । কিন্তু তিনি মুক্তি পাচ্ছেন কবে জানেন ?  ২০১২-এর মে মাসে !


চিনের মন্দারিন ভাষা ছাড়া তিনি নাকি অন্য কোনও ভাষা জানতেন না । তাই তাঁর কথা কেউ বুঝতে পারছিলেন না । এটা কি তাঁর অপরাধ ? এই অপরাধেই তো শিলিগুড়ি আদালত লি-কে দু'বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল । এ কি মানবাধিকার হরণ নয় ? তাঁর বিরুদ্ধে যদিও চিনের গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ উঠেছিল আদালতে, কিন্তু এ অভিযোগ তো সর্বাংশে মিথ্যে, এর কোনও সুস্পষ্ট বা অস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি ।


ree

২০১০-এর অক্টোবর মাসে শিলিগুড়ি জেলে সমীক্ষা করতে গিয়ে দার্জিলিং জেলা লিগ্যাল অ্যাড ফোরামের সম্পাদকমশাই লি-র অবস্থা দেখে চিনা দূতাবাসে যোগাযোগ না-করলে, তাঁকে যে আরও কত বছর কারারুদ্ধ থাকতে হত, ঈশ্বর জানেন ! ইতিমধ্যে নিরপরাধ লি-কে ঘোরানো হয় প্রেসিডেন্সি জেল, সেখান থেকে আলিপুর মহিলা জেল । মাঝখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি । চিনা দূতাবাস থেকে লি-র সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর বাড়ি ও আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে, অবশেষে শুরু হয় তাঁর প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া । আলিপুর আদালত শেষমেশ লি-কে মুক্তি ও প্রত্যর্পণের নির্দেশ দেয় । তারপর কাগজপত্র তৈরি করতে করতে কেটে যায় আরও বেশ ক'টা দিন । সবশেষে তাঁকে মুক্তি দিয়ে কলকাতা থেকে বিমানে কুনমিংয়ে পাঠানো হয় । সেখানে তাঁর বোন দিদিকে সিচুয়ান প্রদেশে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য এসেছিলেন ।


ree

যুগে যুগে অবতারেরা এসেছেন এই দেশে । তাঁরা ক্ষমা করতে বলে গিয়েছেন । ভালবাসতে বলে গিয়েছেন । বিদ্বেষবিষ নাশ করতে বলে গিয়েছেন । রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-গান্ধীজি-রবি ঠাকুরের দেশ ভারতবর্ষ--আমরা কি আরও একটু মানবিক হতে পারি না ? আজ ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে হাতে হাত রেখে সেই শপথই কি নিতে পারি না আমরা ? সত্যি সত্যি পারি না ? যদি না পারি, কী লাভ তবে এই অন্তঃসারশূন্য উদযাপনের ?

 
 
 

Comments


bottom of page