top of page
Search

মালঞ্চের বেড়া



(আজ ১৩ অগস্ট, কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্তের জন্মদিন । ১৯৪২-এর এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ২০০০ এর গোড়ার দিকে । তার তিন বছরের মধ্যেই কবির মৃত্যু । এই মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল খুব । আজ কবির জন্মদিনে কিছু স্মৃতিলেখা...)


ree

'স্বর্গ থেকে টেলিফোন', 'আগুনের ডানা', 'ভালো আছো ভালোবাসা' এই সব বই খুব ছোট থেকে পড়ে কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্তের প্রতি এক অন্য রকম ভাললাগা তৈরি হয়েছিল আমার । পরবর্তীতে যখন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার পোকা ঢুকল মাথায়, তখন থেকেই লক্ষ্য ছিল তাঁর লেখা দিয়ে সংখ্যা সাজানো । তিনি আমার সে সাধ মিটিয়েওছিলেন হাসি মুখে । 'ভালোবাসা'র আবির্ভাব সংখ্যাতেই তিনি কবিতা লিখেছিলেন । এভাবেই গড়ে ওঠে সখ্য ।


২০০৩ সালের ১৯ জানুয়ারি । বেলা ১১.৩০ । হঠাৎ করে চলে গেলেন মঞ্জুষ দাশগুপ্ত । বাংলা কবিতার জগতে শূন্যতার সৃষ্টি তো হয়েছিলই, সে অন্য প্রসঙ্গ; কিন্তু আমার অনতিতরুণ অন্তরাত্মাকে নাড়িয়ে  দিয়েছিল এই একটা মৃত্যু । নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া সে তো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, সাময়িক; কিন্তু আমার লিখতে আসার প্রথম জীবনে এমন একটি মৃত্যু অবচেতনে বড় গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল, বুঝতে পারি । ওই বয়সেই রক্ত আর মৃত্যু ঘুরেফিরে বারবার আসতে শুরু করেছিল আমার কবিতায় ।


ree

কিছু দিন ধরেই তিনি ভুগছিলেন দুরারোগ্য লিউকোমিয়ায় । কিন্তু সৃষ্টিকর্ম থেকে তাঁকে বিরত করা যায়নি কখনওই । আজকের এই প্রেমহীনতার যুগে মঞ্জুষ দাশগুপ্ত এক বিরল প্রজাতির কবি যাঁর কবিতায় অবিনশ্বর প্রেম ফিরে ফিরে এসেছে বারবার । শাশ্বত কালোত্তীর্ণ রোমান্টিক প্রেমের অনুপম জ্যোতিস্পর্শে মঞ্জুষ দাশগুপ্তের কবিতা জাজ্জল্যমান । দুর্বার বিরহ-যন্ত্রণার ঢেউ যেন মুহুর্মুহু আছড়ে পড়েছে তাঁর কবিতার পাড়ে, ভাসিয়ে দিয়েছে এ কূল-ও কূল মুহূর্তের প্লাবনে । না পাওয়ার বিরহ কাতরতাকে, তার আকুলতাকে এত বলিষ্ঠ এত আবেগময় এত ছন্দবদ্ধ কবিতার আঙ্গিকে ফুটিয়ে তুলতে আর কাউকে দেখিনি আমি । এ বোধ হয় তাঁর পক্ষেই সম্ভব, এই সব মনে হত তাঁর কবিতা পড়ে ।


কিছু দিন পরপরই কবিকে রক্ত বদলাতে যেতে হত নার্সিংহোমে । কিন্তু কখনও তাঁকে বীতশ্রদ্ধ হতে দেখিনি জীবনের প্রতি । বরং জীবনের প্রতি এক অকৃত্রিম ভালবাসা তিনি আমৃত্যু লালন করে গিয়েছেন । সৃষ্টির প্রতি ছিল তাঁর দুর্নিবার আকর্ষণ । একান্ত আলাপচারিতায় এই কলমচিকে কবি বলেছিলেন, "আমি ভীষণভাবে একা, কিন্তু এই একাকিত্বের মধ্যেই..."

"শব্দবিহীন অক্ষরগুলি হাত বাড়িয়েছে সখ্যে," তাঁকে শেষ করতে না দিয়েই তাঁর মুখের কথা টেনে নিয়েছিলাম । তারপর নিজেই শুনিয়েছিলেন তাঁর অন্যতম প্রিয় কবিতা 'একা'-- "আমি একা একা সাদা পাতা নিয়ে থাকি নির্জন কক্ষে/ শব্দবিহীন অক্ষরগুলি হাত বাড়িয়েছে সখ্যে ।"


একাকিত্বের কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্তের অন্তরে ছিল শিশুর সারল্য, আর হৃদয় ছিল ভালবাসায় পূর্ণ । তাঁকে না জানলে, তাঁর সঙ্গে না মিশলে এ সব অজানাই থেকে যেত । 'সানন্দা'র কোনও এক সংখ্যায় প্রকাশিত আমার একটি কবিতা পড়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাড়ির ল্যান্ড লাইনে টেলিফোন করে তাঁর মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন আমি জীবনে কোনও দিন ভুলব না । তাঁর সেই ভাললাগার ভাষা, ভাষার সেই বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস, অকপট সারল্যের দলিল । এই ভালবাসা মাখা অনাবিল সারল্যের প্রদীপটুকু তাঁর সমস্ত সৃষ্টির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমৃত্যু দেদীপ্যমান ছিল ।


ree

মৃত্যুচেতনা কবিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল এ কথা সত্যি । 'ভালোবাসা'র আবির্ভাব সংখ্যাতেই প্রকাশিত তাঁর 'এপিটাফ' কবিতাটিতে কবির মৃত্যুচেতনার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে । কিন্তু এই চেতনা তাঁকে কখনওই জীবনবিমুখ করেনি । এই কবিতার মর্মস্পর্শী আবেদন 'ভালোবাসা'র পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল প্রবলভাবে । এই খবরে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন কবি । এবং সম্পাদকের অনুরোধে 'ভালোবাসা'র বৈশাখ ১৪১০ সংখ্যার জন্য একটি গবেষণাধর্মী দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখতে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন । শুরুও করেছিলেন সে লেখা । বিষয় ছিল 'আধুনিক বাংলা কবিতায় প্রেম' । প্রবন্ধের বিশেষ বিশেষ অংশগুলি সময়ে সময়ে প্রায়ই তিনি আমাকে টেলিফোন করে শোনাতেন । কিন্তু সে লেখা আর সম্পূর্ণ হল না ।


আমার করা শেষ টেলিফোনে কবির গলা কম্পমান, "আমি আজই নার্সিংহোমে যাচ্ছি । পারলে তুমি আমার সঙ্গে একবার দেখা কোরো ।"

"আপনি নার্সিংহোম থেকে ফিরুন, আমি খুব তাড়াতাড়ি পর্ণশ্রী পল্লী যাচ্ছি ।"

না । আর যাওয়া হল না । এল উনিশে জানুয়ারির সেই অভিশপ্ত দুপুর । কবি নেই । আমাদের সকলকে ছেড়ে তিনি চলে গেলেন অনন্তলোকে । রেখে গেলেন তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি, এই খিন্ন ক্লান্ত পৃথিবীতে ক্লান্তিনাশের, শ্রান্তিনাশের, বিশ্বপ্রেমের শাশ্বত আবেদন--

"তোমরা আমাকে যারা ভুল বুঝে দূরে সরে আছো

আমার মৃত্যুর পর কাছে এসো । বারান্দায় ঝুঁকে

কৌতুহলী কেউ হয়ে দেখে নিয়ো, শেষ রোদে ছিল

অন্ধকার প্রসারে বাধা দেওয়া মালঞ্চের বেড়া..."

 
 
 

Comments


bottom of page