top of page
Search

রবীন্দ্রদূষণ ও নিরাময় : একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিলেখা


ree

সে বেশ কয়েক বছর আগের কথা । এক বিকৃতরুচির ইউটিউবার তখন ক্রমাগত রবীন্দ্রদূষণ ঘটাচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় । তার প্রভাবে অকালপক্ক কিছু ছেলেমেয়ের তো সাপের পাঁচ পা দেখার অবস্থা--ঠাকুরবাড়ির ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে পড়ে আবির দিয়ে খোলা পিঠে নোংরা শব্দ মিশিয়ে রবি ঠাকুরের গানের লাইন লিখে উদ্বাহু নৃত্য শুরু করেছিল তারা । ইউটিউবারকে গ্রেফতারের দাবি উঠছিল বিভিন্ন মহল থেকে । কিন্তু সে বিষয়ে পুলিশের আগ্রহ ছিল কম, অবিশ্যি পরবর্তীতে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে কুরুচিকর আক্রমণের মাধ্যমে পুলিশকে আগ্রহী করে তুলে সে ইউটিউবার, আমরা সবাই জানি, জেল খেটেছিলেন কিছু দিন ।


তো যে কথা বলছিলাম, রবীন্দ্রদূষণের বিষবাষ্পে দম বন্ধ হয়ে আসছিল বিগত বেশ কিছু দিন থেকেই । এই পরিস্থিতিতে ৮ তারিখ, মানে ৮ মে, যত দূর মনে পড়ে, বিকেল পাঁচটায় রবীন্দ্রসদনে ছিল কবিতাপাঠ । সুবোধদার কবিতা আকাদেমির ডাকে কবিতাপাঠ, তাই না-যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, যদিও বেশিরভাগ কবিতাপাঠেই আমি আর যাই না ইদানীং । কেন যাই না সে ভিন্ন প্রসঙ্গ, সময়-সুযোগ মতো পরে কখনও আলোচনা করা যাবে । এ দিকে ওই দিন সকাল দশটার একটা অনুষ্ঠানে আয়োজকদের কথা দিয়ে রেখেছিলাম অনেক আগে থেকে, তাদের না করারও প্রশ্ন আসে না । কোনও রকমে সে অনুষ্ঠানটা শেষ করে আমার অতি প্রিয় লাল গাড়িটা নিয়ে শান্তিনিকেতন থেকে যখন বেরোলাম তখন ঘড়ির কাঁটা একটার ঘর পেরিয়ে গিয়েছে, স্পষ্ট মনে আছে ।  এমনিতেই লেটে রান করছি, মন-মেজাজও বেশ খারাপ, তার ওপর আবার গুসকরার কাছাকাছি পৌঁছে ঘটল বিপত্তি । লাল গাড়ি সবিনয়ে তার অসম্মতির কথা জানাল, যদিও এর আগে সে কোনও দিন এমন অসহযোগিতা করেনি আমার সঙ্গে ।


ree

খুব দ্রুত মারুতি সুজুকির লোক এলেন, দেখলেন, জানালেন চিকিৎসার জন্য কিছু সময়ের প্রয়োজন । কিন্তু আমার তো সময়েরই অভাব ! এখন উপায় ? সহযোগিতার হাত বাড়ালেন ওঁরাই । আমার বীরভূমেরই অন্য একটা বাড়ির গ্যারেজ থেকে অতি দ্রুততায় আমার সাদা গাড়িটা আনিয়ে দিলেন ওঁরা, যদিও এর সঙ্গে 'প্রফেশনালিজমে'র কণামাত্র সম্পর্ক নেই, কারণ এই সাদা গাড়ি ওঁদের নয়, হুন্ডাইয়ের । ফোন করলাম আয়োজকদের, "৬ মে আমার পাঠ ছিল, পিছিয়ে ৮ তারিখ করার আবদার করেছিলাম । ফের আবদার করতে লজ্জা করছে, আমার পৌঁছতে নির্ধারিত সময়ের থেকে বেশ অনেকটা দেরি হবে ।" বলা বাহুল্য, ওঁরা আমার শেষ আবদারও মেনে নিলেন, যদিও আমার চিরবিশ্বস্ত ড্রাইভার আমাকে আশ্বস্ত করল বরাবরের মতোই, "চিন্তা করবেন না স্যার, অত দেরি হবে না, আমি টেনে দেব । ম্যাক্সিমাম আধ ঘণ্টা লেট হবে ।"


ree

যেমন কথা তেমন কাজ । পৌঁছলাম নির্ধারিত সময়ের আধ ঘণ্টা পরেই । আসন্ন ২৫ বৈশাখের আলোয় তখন ঝলমল করছে সমগ্র রবীন্দ্রসদন-নন্দন চত্বর । কী অপূর্ব মায়াবী এক সন্ধে ! তার সারা শরীর জুড়ে যেন স্পর্শ লেগে আছে রবি ঠাকুরের । তালপাতাটির স্নিগ্ধ হওয়ার মতো সেই স্পর্শ, কলসির টাটকা জলের মতো শীতল সেই স্পর্শ, ভেতরঘরে মাদুর বিছিয়ে দেওয়ার মতো 'আপন' সেই স্পর্শ ! এই স্পর্শ বাঙালির হাজার বছরের ক্লান্তিকে মুছে দিতে পারে এক লহমায়, তার অবসাদ জুড়ে নিরাময় লিখে দিতে পারে জন্ম-জন্মান্তরের, তার অনুতাপ জুড়ে টেনে দিতে পারে শতাব্দীলালিত শুশ্রূষার কাজল ! উপলব্ধি করলাম, অভিশাপের মতো ধেয়ে আসা রবীন্দ্রদূষণের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া আদপে কোনওই ক্ষতি করতে পারবে না আমাদের ! কারণ তিনি স্বয়ং ছড়িয়ে আছেন আমাদের সমস্ত জীবন জুড়ে, কী এক আশ্চর্য মায়ায় বেঁধে রেখেছেন একটা সমগ্র জাতিকে, যুগ যুগ ধরে !


ree

ক'দিনের বিষাক্ত বিবমিষায় বিষণ্ণ হয়ে থাকা মন আমার হঠাৎ ভাল হয়ে গেল সেই রবি ঠাকুরেরই ছোঁয়ায়, যাঁর কাছে এ-জাতির আজন্মলালিত ঋণ, বোধ হয়, কোনও দিন শোধ হবার নয় ।


এই ফুরফুরে মন নিয়েই যখন শান্তিনিকেতনের বাড়িতে ফিরলাম, তখন ২৫ বৈশাখের ভোর ফুটছে অদূরে ! কনকচূড়া, করঞ্জা, কামিনী, জারুল, দেবদারু আর নাগকেশরের ডাক যেন ভেসে আসছে বাড়ির উঠোনে ! আকাশ যেন আতর মেখে প্রস্তুত হয়েই আছে দিগন্তে ! আমার রোগমুক্ত আদরের লাল গাড়ি যেন গ্যারেজ থেকে উঁকি মেরে আমায় স্বাগত জানাল, "সুসকাল ।"


ree

(ছবিঋণ : বিবিসি, যুগান্তর)

 
 
 

Comments


bottom of page