top of page
Search

শিক্ষক দিবস : একটি নিছক উদযাপন



(আজ ৫ সেপ্টেম্বর । ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন । সারা দেশে এই দিনটিকে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা হয় । এই পালনের উদ্দেশ্য কি শুধুই জন্মদিন উদযাপন ? )


ree

তামিলনাড়ুর এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ (৫ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮ -- ১৭ এপ্রিল ১৯৭৫) দীর্ঘ দশ বছর (১৩ মে ১৯৫২ -- ১২ মে ১৯৬২) দেশের উপরাষ্ট্রপতি ও ১৯৬২-র ১৩ মে থেকে ১৯৬৭-র ১৩ মে পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন, এ কথা আমরা সবাই জানি । আমরা এও জানি, তাঁর শুভ জন্মদিন উপলক্ষে ৫ সেপ্টেম্বর দিনটি সারা দেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মর্যাদার সঙ্গে 'শিক্ষক দিবস' হিসেবে উদযাপিত হয় । এখন প্রশ্ন হল, তাঁর জন্মদিন পালনেই কি ফুরিয়ে যায় 'শিক্ষক দিবস' উদযাপনের সমস্ত দায়-দায়িত্ব ? আরও স্পষ্ট করে বললে, এই দিনটি পালনের নীতিগত উদ্দেশ্য কি শুধুই ড. রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন উদযাপন ?


ree

না । এই উদ্দেশ্য আরও অনেক গভীরে প্রোথিত । এই উদ্দেশ্য একটি সম্পর্কের বুনিয়াদকে দৃঢ়তর করবার সংকল্প গ্রহণের আদর্শে নিহিত । এই সম্পর্ক ছাত্র-শিক্ষকের । আজকাল রাস্তাঘাটে, বাসে-ট্রেনে, হাটে-বাজারে, সভা-সমিতিতে, এবং অবশ্যই বাঙালির মজলিশি আড্ডায়, প্রায়শই শোনা যায়, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নাকি তলানিতে এসে ঠেকেছে; এই সম্পর্কের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই ! হাড়-কঙ্কাল বেরিয়ে পড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এই সম্পর্ক ! কতখানি সঠিক এই মূল্যায়ন ? কতখানিই বা যথার্থ এই উপলব্ধি ?


একটা ছোট্ট গল্প বলি । খুব ছোটবেলায় আমার অত্যন্ত প্রিয় একটা জামা গায়ে আর আঁটছিল না দেখে মা বলেছিলেন, "জামাটা ছোট হয়ে গেছে সোনা, ওটা পরে না !" সেই শিশুমনেই প্রতিক্রিয়া হয়েছিল প্রবল--জামা আবার ছোট হয় নাকি ? জামা তো জড় পদার্থ ! স্কুলে গিয়ে আন্টিকে ধরতেই, আন্টি পিঠ চাপড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, "জামা কখনও ছোট হয় না দুষ্টু, তুমিই বড় হয়ে গেছ !" তারপর কত চাঁদডুবি হয়ে গেছে আকাশে ! কত ফুল ঝরে গেছে শিউলিতলায় ! পৃথিবী বদলে গেছে ।


এখন খবরের কাগজে পড়ি, 'নদীয়ার শিক্ষক নিগৃহীত ছাত্রের হাতে' । জনৈক শিক্ষক টোকাটুকিতে বাধা দিয়েছিলেন । বাধা মানেনি দু'চারজন । সাবধান করেছিলেন শিক্ষক । তাতেও কাজ হয়নি । বাধ্য হয়েই খাতা কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি । আর তখনই শুনেছিলেন শাসানিটা--"দেখে নেব !" দেখে নেবে ? বিশ্বাস হয়নি । তাই কোনও রকম সতর্কতা অবলম্বনের ধার ধারেননি তিনি । কাউকে কিছু জানানওনি । এর পর ফেরার সময়ে ঘটে গেল সেই ভয়ঙ্কর অবিশ্বাস্য কাণ্ডটা--শিক্ষককে টেনে হিঁচড়ে বাস থেকে নামাল ছাত্ররা । ধস্তাধস্তি, গায়ে হাত, অকথ্য গালিগালাজ ! তৈরি হল ক্যাপশন--'শিক্ষক নিগৃহীত ছাত্রের হাতে !' 


টেলিভিশনের পর্দায় দেখি, 'ছাত্রের হাতে লাঞ্ছিত শিক্ষক আত্মঘাতী উত্তরবঙ্গে ।' ছাত্রকে অন্যায়ভাবে পাশ করানোর আবদার রাখেননি শিক্ষক । রাগ পুষে রেখে ছাত্রটি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে । কোনও এক বান্ধবীকে দিয়ে সে শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনে শিক্ষকের বিরুদ্ধে । সামাজিক অপমানের ভয়ে, লজ্জায় আত্মহননের চরম পথ বেছে নেন শিক্ষক ।


ree

তাই বলে কি উলটোটা নেই ? উলটোটাও আছে । এবং সমান তালেই । 'শিক্ষকের প্রহারে নিহত প্রতিবন্ধী ছাত্র' । শিক্ষকের আদেশ মান্য করেনি ছাত্র । তাকে পুনর্বার আদেশ করলে, অশক্ত রুগণ ছাত্রটি বিরক্তিভরে অগ্রাহ্য করেছে শিক্ষককে, অভিযোগ এমনই । রুষ্ট শিক্ষক এলোপাথাড়ি পেটাতে থাকেন তাকে । সে সংজ্ঞা হারায়; স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছলে চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন । 


শিক্ষক ছাত্রীকে বিছানায় ডাকছেন, সে ডাক অমান্য করলে ছাত্রীটির কেরিয়ার চিরদিনের মতো শেষ হয়ে যাবে ! তার এত বছরের মুখ-দিয়ে-রক্ত-তোলা অর্জন এক লহমায় মুখ থুবড়ে পড়বে ! ছাত্রী কিংকর্তব্যবিমূঢ় ! কী করবে সে ? কোথায় যাবে ? নালিশ করবে ? মেনে নেবে ? তার অসহায়তার কোনও কূল নেই, কোনও কিনারা নেই !


ree

এই সব দেখে শুনে মনে হয়--সত্যিই মনে হয়--মনুষ্যত্ব ছোট হয়ে গেল না তো ? ছাত্রের হৃদয়ে কি আর কোনও সম্মানই অবশিষ্ট নেই শিক্ষকের জন্য ? শিক্ষকও কি আর ভাবেন ছাত্রদের কথা ? ভালবাসেন ? ত্যাগ-তিতিক্ষা-উৎসর্গ ? না । মনুষ্যত্ব ছোট হয়ে যায়নি । এখনও প্রিয় শিক্ষকের বদলির অর্ডার এলে কেঁদে ভাসিয়ে দেয় ছাত্র, অবরোধ হয় বিদ্যালয়ের গেটে । এখনও শিক্ষককে বাঁচাতে ছাত্রই বুক পেতে দেয় নির্দ্বিধায় ! এখনও মৃত্যুপথযাত্রী ছাত্রের বিরল রোগের চিকিৎসায় বিপুল অর্থ দান করেন শিক্ষকই ! এখনও নাবালিকা ছাত্রীটির বিয়ে রুখে দিয়ে অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে তাকে রক্ষা করেন শিক্ষকই !


ree

আমার ওই পুরনো জামার মতোই মনুষ্যত্ব তাই ছোট হয়ে যায়নি, কিন্তু আমাদের জীবন সংগ্রামের ক্ষেত্রটা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে ! আর এই বড়ত্ব বড় অশুভ, বড় অসুস্থ, বড় অসংযত, বড় বিকারগ্রস্ত ! কোনও সন্দেহ নেই, শিক্ষা তার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে সম্পূর্ণ ভ্রষ্ট হয়েছে আজ । তার এক এবং একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন-তেন-প্রকারেণ অর্থোপার্জন ! তাই দেশময় এত উন্মত্ত ইঁদুরদৌড়, এত অসহিষ্ণু উতরোল, এত নেশাগ্রস্ত প্রতিযোগিতা, এত অচরিতার্থতার হাহাকার, এই জটিলতম জটিলতা...! এই জটিলতার বেড়াজাল থেকে শিক্ষাকে বের করে এনে, তাকে সব রকমের কলুষমুক্ত করে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অধুনা দুর্বল বুনিয়াদকে দৃঢ়তর রূপে পুনর্নিমাণের শপথগ্রহণেই 'শিক্ষক দিবস' উদযাপনের যথার্থতা প্রতিপন্ন হতে পারে বলে মনে হয় ।


(ছবিঋণ : আনন্দবাজার, হিন্দুস্থান টাইমস বাংলা, খবর অনলাইন ।)


 
 
 

Comments


bottom of page