top of page
Search

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় : অগোছালো রোমন্থন



(আজ ১৫ নভেম্বর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিন । তাঁর মৃত্যুর পরের দিনই চোখের জলে এই স্মৃতিচারণামূলক লেখাটি লিখতে হয়েছিল সংবাদমাধ্যমের অনুরোধে । আজ তাঁর মৃত্যুদিনে লেখাটি ফিরে পড়া...)


ree

আমার জীবনে সৌমিত্রদার অবদান কতখানি এ-কথা বোধ হয় লিখে বোঝানো সম্ভব নয় কোনও দিনই । এই সামান্য লেখক জীবন থেকে শুরু করে কিঞ্চিৎ ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র জীবনে যতটুকুই পদার্পণ করেছি, তাঁর অবদান অনস্বীকার্য । আজ পিছনে তাকিয়ে দেখি, আমার যে সব কবিতা নিয়ে অডিয়ো ভিডিয়ো কিংবা মুভির কাজ হয়েছে, তার অন্তত ষাট শতাংশেই সৌমিত্রদার উপস্থিতি । আমার সামান্য কবিতাগুলো তাঁর অসামান্য কণ্ঠের জাদুতে, কিংবা অতুলনীয় অভিনয়ের ছোঁয়ায়, যেভাবে মানুষের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠেছে দিনে দিনে, তা এ-জীবনের এক পরম প্রাপ্তি । আমার ইহজীবনের আরেক চরম সৌভাগ্য, অমন এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পীকে নিজের পরিচালিত একাধিক কবিতামুভিতে শিল্পী হিসেবে পাওয়া । ওই সব কাজের নেপথ্যে যে দীর্ঘ, দীর্ঘতর সময় অতিবাহনের সুযোগ পেয়েছি রূপকথার রাজপুত্রের সঙ্গে, সেও এক আশ্চর্য ঐশ্বর্য বইকি । সেই সব নিবিড় আনন্দঘন স্বর্গীয় মুহূর্তগুলোর অপ্রতিরোধ্য রোমন্থন আজ বড় বেদনায় আবিষ্ট করে তুলছে মন ।


ree

দেশে-বিদেশে লাইভ শোয়ের জন্য সৌমিত্রদাকে নিয়ে আমাদের একটা দল তৈরি হয়েছিল । সৌমিত্রদা ছাড়া সেই দলে ছিলেন প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী মোহন সিং খাংগুরা, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী শ্রাবণী সেন, নৃত্যশিল্পী রাজদীপ ও সম্প্রদায়, আবৃত্তিশিল্পী বন্ধু দোয়েল বড়ুয়া, রেডবাড মিডিয়ার কর্ণধার বন্ধু বিশাখ সেন, এই অধম এবং আরও অনেকে । এই দল বিভিন্ন মঞ্চে আমার কবিতার লাইভ সিনেমাটোগ্র্যাফিক শো পরিবেশন করত । এক একবারে আমার দশ-বারোটি কবিতার লাইভ সিনেমাটোগ্র্যাফিক প্রেজেন্টেশন মঞ্চস্থ হত নৃত্য-গীত-অভিনয় সহযোগে । ঠিক যেমনটা হয়েছিল মহাজাতি সদনে, আমার লেখক জীবনের কুড়ি বছরে পদার্পণ উপলক্ষে । টানা আড়াই ঘণ্টার ওই মঞ্চায়ন কী অনাবিল মুগ্ধতায় দেখেছিলেন সাড়ে পাঁচশো মানুষ ! অনুষ্ঠান শেষে সহর্ষ করতালির মধ্যে দর্শকদের উদ্দেশে সৌমিত্রদা বললেন, "আমি আপনাদের জন্যই বেঁচে আছি ।" ঠিক তক্ষুনি একটা আস্ত চাঁদ যেন অনাদিকালের জ্যোৎস্না নিয়ে জেগে উঠেছিল সেই মুখে ! সমালোচকরা বললেন, বাংলা কবিতার এমন শো এ-উপমহাদেশে ইতিপূর্বে কখনও হয়নি ।


ree

তো যে কথা বলছিলাম, মহাজাতি সদন সহ আরও বেশ কয়েক জায়গায় এই শোয়ের বিপুল সাফল্যের পর আসামের গুয়াহাটি থেকে আমন্ত্রণ এল আমাদের । আমন্ত্রণ এল বাংলাদেশ, গ্রেট ব্রিটেন, কানাডা, ইউএসএ থেকেও । সৌমিত্রদা ইউএসএ যেতে সম্মত হলেও, বাংলাদেশ যেতে অস্বীকার করলেন যে কোনও কারণেই হোক । ফলে আয়োজকরা দূরের সফরের জন্যই প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন । মোটামুটি স্থির হল, কানাডা আর আমেরিকা পাশাপাশিই রাখা হবে । তারপরই উনি অসুস্থ হলেন ।



যদি ভুল না করি, ১৪ আগস্ট, ২০১৯ ওঁকে ভর্তি করা হল অ্যাপোলো গ্লেনেগেলসে । টানা ছ'দিনের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা উত্তেজনা ! লাখ লাখ বাঙালির আগলহীন আবেগ আর ভালবাসায় সুস্থ হয়ে ২১ আগস্ট ঘরে ফিরে এলেন সৌমিত্রদা । ডাক্তারবাবুর কড়া নির্দেশ--বিশ্রাম, বিশ্রাম, বিশ্রাম!... খুব আনন্দ পেয়েছিলাম সে দিন । এত আনন্দ পেয়েছিলাম যে, ঘরে এসে বসলে সৌমিত্রদার হাফ প্যান্ট পরা ছবিই পোস্ট করে দিয়েছিলাম ফেসবুকে, লিখেছিলাম, "আমরাও যেন তাঁকে বিশ্রামের সময়টুকু থেকে বঞ্চিত করতে উদ্যত না হই কোনও মূল্যেই, কোনওভাবেই !" নীচে জনৈক ফেসবুক ইউজারের কমেন্ট দেখে খুব হেসেছিলাম, "আপনি কেন বিরক্ত করতে গিয়েছেন তবে ?"



হ্যাঁ, বিরক্ত আমরা খুব করেছি তাঁকে, আর যত বিরক্ত করেছি তত বেশি প্রশ্রয় পেয়েছি । এখনও তাঁর সঙ্গে তিন-তিনটে কাজ অসম্পূর্ণ হয়ে পড়ে আছে, (তারই মধ্যে একটি, 'আকাশ ভেঙে পড়ে', কৃষ্টি ক্রিয়েশন দু'য়েক দিনের মধ্যেই প্রকাশ করবে সম্ভবত) যেগুলোর শুটিং কিংবা রেকর্ডিং চলাকালীনই মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ করে মানুষের থেকে অপেক্ষাকৃত উন্নত বুদ্ধির জীব আস্তে আস্তে দখল নিতে শুরু করল পৃথিবীর । পৃথিবী বদলে গেল । সেই বদলে যাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলেন না কাজপাগল সৌমিত্রদা ।



দম বন্ধ হয়ে আসা শ্বাসরোধী পৃথিবীতে ওই ভয়ঙ্কর জীবগুলোই ধীরে ধীরে পেড়ে ফেলল সৌমিত্রদাকে, শরীরে প্রবেশাধিকার না পেয়ে মনেই ঢুকে পড়ল প্রথমে--অবসাদ গ্রাস করল তাঁকে । ওই সময়ে ফোন করলেও ভালভাবে কথা বলতেন না সৌমিত্রদা । যে-মানুষটার সঙ্গে ফোনে প্রায় নিয়মিত কথা হত একটা সময়ে, সেই মানুষটাই ফোন ধরা প্রায় বন্ধ করে দিলেন । খুব ভয় পেলাম মনে মনে--আমি তো যেতে পারছি না কোনও ভাবেই, ফোন না ধরলে কী করে বোঝাব ওঁকে, 'ভিখারি রাঘবে ডরাবেন' শেষে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতিপুরুষ ?


ree

সত্যি সত্যিই মনে মনে ভেঙে পড়লেন সৌমিত্রদা । আর সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে ভাইরাস ঢুকে পড়ল শরীরে । টানা একচল্লিশ দিনের অসম যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল অবশেষে । আর কিছুই করা গেল না, শেষ দেখাটাও দেখতে পেলাম না তাঁকে ! এ-আক্ষেপ আমার সারা জীবনেও যাবে না ! যে-বাড়ির অন্দরমহলে ছিল আমার অবাধ অনন্ত যাতায়াত, আজ সংবাদ মাধ্যমে সেই বাড়ির সদর দরজার হাহা শূন্য ছবি দেখে পায়ের তলার মাটি যেন মৌহুর্তিক ভূমিকম্পে টলে উঠল, শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া জিভে এক অনির্বচনীয় খরার অনুভূতি, আর বুকের ভেতর কুলপ্লাবী বন্যার ছলচ্ছল...


এই স্বজনবিয়োগব্যথা আমার সারিয়ে দাও, ঈশ্বর !!!


(শান্তিনিকেতন, ১৬.১১.২০২০)


 
 
 

Comments


bottom of page