top of page
Search

স্মৃতির পাতায় : নবনীতা দেবসেন




(আজ ৭ নভেম্বর, নবনীতা দেবসেনের মৃত্যুদিন । কিছু স্মৃতির কোলাজ প্রিয় পাঠকদের জন্য ।)


ree

নবনীতাদির সম্পর্কে আর কী লিখব ? এত স্মৃতি ভিড় করে আছে মনে যে এই ৭ নভেম্বর এলেই বড় ভারী হয়ে যায় মন ।


যখন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতাম--সে বহু বছর আগের কথা--তখন থেকেই তাঁর অকৃপণ ভালবাসা পেয়ে এসেছি ! আমার সম্পাদিত পত্রিকার নাম ছিল ওঁর বাড়ির নামে ! হয়তো কাকতালীয়ই, কিন্তু তাঁর আবেগপ্রবণ হৃদয় এই জিনিসটাকে চিরকাল অন্য চোখে দেখে এসেছে ! হয়তো সেজন্যই, নয়তো অন্য কারণে, 'ভালোবাসা'র কোনো সংখ্যাই তাঁর গদ্য বা কবিতা বা অনুবাদ কর্ম ছাড়া বেরোত না । সময় সুযোগে কখনও  সে লেখাগুলো পড়াব আপনাদের ।


ree

একবার হলদিয়ায়, মনে আছে, সবার মাঝে আমায় আদর করে দিয়েছিলেন গাল টিপে, সঙ্গে আমার সম্পর্কে অনেক ভাল ভাল কথা ! আমি তখন অনেক ছোট, সবে এক-দুটো কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে ! ভীষণই লজ্জা পেয়ে টুপ করে প্রণাম করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেছিলাম, মনে পড়ে ।


আমার যখন প্রথম গদ্যের বই বেরোবে, সমস্ত পাণ্ডুলিপিটা গভীর মমতায় পড়ে দেখেছিলেন তিনি । সাজিয়ে দিয়েছিলেন গদ্যগুলো । প্রয়োজনীয় পরামর্শ/ উপদেশ দিয়ে সুন্দর করে একটা ভূমিকাও লিখে দিয়েছিলেন সে-বইয়ের ! 'পুনশ্চ' থেকে কলকাতা পুস্তকমেলায় 'সামান্য লেখা' বেরোল তাঁর একটি অসামান্য ভূমিকায় সমৃদ্ধ হয়ে ।  সে-ভূমিকার কথা আমার পাঠকমাত্রই জানেন, সামাজিক মাধ্যমেও বহুবার তাঁরা এ নিয়ে মন্তব্য করেছেন ।


ree

একবার সুনীলদার ওখানে, কৃত্তিবাসের অনুষ্ঠানে, মনে পড়ছে, তিনজনের কবিতাপাঠ ছিল--মল্লিকাদি, জয়দেবদা আর আমি । পাঠের পর তাঁর অকৃত্রিম স্নেহস্পর্শে  ধন্য হয়েছি । সে দিন নন্দনাও এসেছিল, মনে আছে । সুবোধদা ছিলেন, পিনাকীদা, কৃষ্ণাদি, আরও অনেকে ।


নবনীতাদির ভালবাসা ছিল সমুদ্রের মতো অগাধ, অকৃপণ ! তাঁর অপরিসীম উচ্চতা কিংবা বয়সোচিত গাম্ভীর্য কোনওটাই কখনওই আমার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি । কত কতবার তাঁকে নিজের অনুষ্ঠানে নির্দ্বিধায় আমন্ত্রণ জানিয়েছি, আয়োজকদের দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি, কখনও তিনি বিরূপ করেননি আমায় । এ আমার পরম সৌভাগ্য । শেষবারও, এই তো সে দিন, একটা অ্যালবাম রিলিজ অনুষ্ঠানে, অশক্ত শরীরে লাঠি হাতে--লাঠি নয়, আমরা বলতাম, জাদুদণ্ড--তিনি কিছুক্ষণের জন্য হলেও এসেছেন, এসে বসে থেকেছেন দর্শকাসনে, মঞ্চে উঠে কথা বলতে পারেননি । তাঁর সেই অমোঘ উপস্থিতিটুকুই আমার সারা জীবনের প্রেরণা হয়ে থাকবে !


ree

আর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে খুব, যদিও সে কথা এখানে শেয়ার করা উচিত হচ্ছে কি না আমি জানি না, 'দীপ প্রকাশন' থেকে একটা ঢাউস বই 'অভীপ্সিত রবীন্দ্রনাথ' সম্পাদনা করছি তখন । প্রায় সব লেখাই চলে এসেছে হাতে । কিন্তু মন আমার সন্তুষ্ট নয় কিছুতেই । একটাই কারণ--অনেক চেষ্টা করেও অমর্ত্যবাবুর একখানা লেখা পাইনি । তিনি সরাসরি  'না' করে দিয়েছেন । দ্বারস্থ হলাম নবনীতাদির, নাছোড় সম্পাদকের শেষতম প্রচেষ্টা বলতে পারেন ! কী আশ্চর্য, নবনীতাদির অলীক জাদুমন্ত্রে  সে কাজটিও হাসিল হয়ে গেল ! এবং খুব সুচারুভাবেই । অমর্ত্যবাবু সময় দিলেন । লেখাও । সেই লেখা দিয়েই শুরু হল গ্রন্থটি । পরবর্তীতে ওই বই দীর্ঘদিন বাংলা বইবাজারে 'বেস্ট সেলারে'র তকমা নিয়ে রাজত্ব করেছে, সে কথা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন ।


ree

একবার হয়েছে কী, দিদির সঙ্গে ভীষণ প্রয়োজন । কিন্তু তিনি তখন বিদেশে । কোনওভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না । শেষমেশ নন্দনা দিল তাঁর মেইল আই ডি । যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম ! আর আজ ? কোথায় পাব তাঁর মেইল আই ডি ? কত কতবার তো তাঁর কলকাতার বাড়িতে গিয়েছি, আর গেলে পাব তাঁর দেখা ? ল্যান্ড লাইনে  ফোন করলে শেষ দিকে বেশিরভাগ সময়েই বাড়ির পরিচারিকা ফোন ধরতেন, "উনি এত দূর আসতে পারছেন না, মোবাইলে করুন !" মোবাইলে কখনও ফোন না-ধরা হতেন না !


আর মোবাইল ধরবেন আমার ? ধরবেন কোনও দিন ? যে মানুষটা আমাকে 'সোনা' বলে সম্বোধন করতেন, আদর করতেন অনির্বচনীয় স্নেহে, এই অনাগত শীতের হাওয়ায়, এই বৃষ্টিসম্ভবা আকাশের নীচে, নিভৃত স্বজনবিয়োগব্যথায় আজ তাঁর জন্য বুকের ভেতরটা বড় হু হু করে উঠছে !



(লেখাটি অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত রঞ্জিতা চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত 'বাতায়ন' পত্রিকায় প্রকাশিত ।)


(ছবিঋণ : আনন্দবাজার, জিনিউজ ইন্ডিয়া ।)

 
 
 

Comments


bottom of page