স্মৃতির পাতায় : নবনীতা দেবসেন
- rajatsubhrablog
- Nov 7, 2023
- 3 min read
(আজ ৭ নভেম্বর, নবনীতা দেবসেনের মৃত্যুদিন । কিছু স্মৃতির কোলাজ প্রিয় পাঠকদের জন্য ।)

নবনীতাদির সম্পর্কে আর কী লিখব ? এত স্মৃতি ভিড় করে আছে মনে যে এই ৭ নভেম্বর এলেই বড় ভারী হয়ে যায় মন ।
যখন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতাম--সে বহু বছর আগের কথা--তখন থেকেই তাঁর অকৃপণ ভালবাসা পেয়ে এসেছি ! আমার সম্পাদিত পত্রিকার নাম ছিল ওঁর বাড়ির নামে ! হয়তো কাকতালীয়ই, কিন্তু তাঁর আবেগপ্রবণ হৃদয় এই জিনিসটাকে চিরকাল অন্য চোখে দেখে এসেছে ! হয়তো সেজন্যই, নয়তো অন্য কারণে, 'ভালোবাসা'র কোনো সংখ্যাই তাঁর গদ্য বা কবিতা বা অনুবাদ কর্ম ছাড়া বেরোত না । সময় সুযোগে কখনও সে লেখাগুলো পড়াব আপনাদের ।

একবার হলদিয়ায়, মনে আছে, সবার মাঝে আমায় আদর করে দিয়েছিলেন গাল টিপে, সঙ্গে আমার সম্পর্কে অনেক ভাল ভাল কথা ! আমি তখন অনেক ছোট, সবে এক-দুটো কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে ! ভীষণই লজ্জা পেয়ে টুপ করে প্রণাম করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেছিলাম, মনে পড়ে ।
আমার যখন প্রথম গদ্যের বই বেরোবে, সমস্ত পাণ্ডুলিপিটা গভীর মমতায় পড়ে দেখেছিলেন তিনি । সাজিয়ে দিয়েছিলেন গদ্যগুলো । প্রয়োজনীয় পরামর্শ/ উপদেশ দিয়ে সুন্দর করে একটা ভূমিকাও লিখে দিয়েছিলেন সে-বইয়ের ! 'পুনশ্চ' থেকে কলকাতা পুস্তকমেলায় 'সামান্য লেখা' বেরোল তাঁর একটি অসামান্য ভূমিকায় সমৃদ্ধ হয়ে । সে-ভূমিকার কথা আমার পাঠকমাত্রই জানেন, সামাজিক মাধ্যমেও বহুবার তাঁরা এ নিয়ে মন্তব্য করেছেন ।

একবার সুনীলদার ওখানে, কৃত্তিবাসের অনুষ্ঠানে, মনে পড়ছে, তিনজনের কবিতাপাঠ ছিল--মল্লিকাদি, জয়দেবদা আর আমি । পাঠের পর তাঁর অকৃত্রিম স্নেহস্পর্শে ধন্য হয়েছি । সে দিন নন্দনাও এসেছিল, মনে আছে । সুবোধদা ছিলেন, পিনাকীদা, কৃষ্ণাদি, আরও অনেকে ।
নবনীতাদির ভালবাসা ছিল সমুদ্রের মতো অগাধ, অকৃপণ ! তাঁর অপরিসীম উচ্চতা কিংবা বয়সোচিত গাম্ভীর্য কোনওটাই কখনওই আমার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি । কত কতবার তাঁকে নিজের অনুষ্ঠানে নির্দ্বিধায় আমন্ত্রণ জানিয়েছি, আয়োজকদের দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি, কখনও তিনি বিরূপ করেননি আমায় । এ আমার পরম সৌভাগ্য । শেষবারও, এই তো সে দিন, একটা অ্যালবাম রিলিজ অনুষ্ঠানে, অশক্ত শরীরে লাঠি হাতে--লাঠি নয়, আমরা বলতাম, জাদুদণ্ড--তিনি কিছুক্ষণের জন্য হলেও এসেছেন, এসে বসে থেকেছেন দর্শকাসনে, মঞ্চে উঠে কথা বলতে পারেননি । তাঁর সেই অমোঘ উপস্থিতিটুকুই আমার সারা জীবনের প্রেরণা হয়ে থাকবে !

আর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে খুব, যদিও সে কথা এখানে শেয়ার করা উচিত হচ্ছে কি না আমি জানি না, 'দীপ প্রকাশন' থেকে একটা ঢাউস বই 'অভীপ্সিত রবীন্দ্রনাথ' সম্পাদনা করছি তখন । প্রায় সব লেখাই চলে এসেছে হাতে । কিন্তু মন আমার সন্তুষ্ট নয় কিছুতেই । একটাই কারণ--অনেক চেষ্টা করেও অমর্ত্যবাবুর একখানা লেখা পাইনি । তিনি সরাসরি 'না' করে দিয়েছেন । দ্বারস্থ হলাম নবনীতাদির, নাছোড় সম্পাদকের শেষতম প্রচেষ্টা বলতে পারেন ! কী আশ্চর্য, নবনীতাদির অলীক জাদুমন্ত্রে সে কাজটিও হাসিল হয়ে গেল ! এবং খুব সুচারুভাবেই । অমর্ত্যবাবু সময় দিলেন । লেখাও । সেই লেখা দিয়েই শুরু হল গ্রন্থটি । পরবর্তীতে ওই বই দীর্ঘদিন বাংলা বইবাজারে 'বেস্ট সেলারে'র তকমা নিয়ে রাজত্ব করেছে, সে কথা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন ।

একবার হয়েছে কী, দিদির সঙ্গে ভীষণ প্রয়োজন । কিন্তু তিনি তখন বিদেশে । কোনওভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না । শেষমেশ নন্দনা দিল তাঁর মেইল আই ডি । যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম ! আর আজ ? কোথায় পাব তাঁর মেইল আই ডি ? কত কতবার তো তাঁর কলকাতার বাড়িতে গিয়েছি, আর গেলে পাব তাঁর দেখা ? ল্যান্ড লাইনে ফোন করলে শেষ দিকে বেশিরভাগ সময়েই বাড়ির পরিচারিকা ফোন ধরতেন, "উনি এত দূর আসতে পারছেন না, মোবাইলে করুন !" মোবাইলে কখনও ফোন না-ধরা হতেন না !
আর মোবাইল ধরবেন আমার ? ধরবেন কোনও দিন ? যে মানুষটা আমাকে 'সোনা' বলে সম্বোধন করতেন, আদর করতেন অনির্বচনীয় স্নেহে, এই অনাগত শীতের হাওয়ায়, এই বৃষ্টিসম্ভবা আকাশের নীচে, নিভৃত স্বজনবিয়োগব্যথায় আজ তাঁর জন্য বুকের ভেতরটা বড় হু হু করে উঠছে !
(লেখাটি অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত রঞ্জিতা চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত 'বাতায়ন' পত্রিকায় প্রকাশিত ।)
(ছবিঋণ : আনন্দবাজার, জিনিউজ ইন্ডিয়া ।)



Comments