সভ্যতার মৃতদেহ
- Rajatsubhra Majumdar

- Feb 14, 2023
- 3 min read
Updated: Feb 24, 2023
মানব সমাজের উন্নত জীবনযাত্রাকে 'সভ্যতা' বা 'Civilization' বলা হয় । এই সভ্যতা একদিনে অর্জন করেনি মানুষ । সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, একটু একটু করে কীভাবে শিষ্টাচার শিখেছে সে, শিখেছে শৃঙ্খলা, উন্নত করেছে রুচি; আর এভাবেই পিছনে ফেলেছে অন্য প্রজাতিকে । মৃতকে সমাধিস্থ করার সভ্যতাও বহু পুরনো । সমাধিসৌধের ভেতরে মৃতদেহের সঙ্গে তার ব্যবহার্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, অস্ত্রশস্ত্র...এই সব সাজিয়ে দিত মানুষ । এই অর্পণ--সন্দেহ নেই, প্রতীকী--এক প্রকার সম্মাননা । সেই তখন থেকেই মানুষ শিখেছে মৃতকে সম্মান করার সভ্যতা । মৃতকে মমি করে রাখার মিশরীয় সভ্যতাও তো আসলে মৃতকে সম্মান জানানোরই শিষ্টাচার ।

অথচ এই শতাব্দীতে মৃতদেহ নিয়ে আমাদের কিছু বিগর্হিত কাণ্ডকারখানা আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, মানুষ পিছু হাঁটছে, সভ্যতা থেকে বর্বরতার দিকে । ছোট্ট একটা-দুটো উদাহরণ এখানে তুলে ধরতে চাই । উত্তরপ্রদেশের সীতাপুর জেলার বসন্তপুর গ্রামের ঘটনা । খুবই সামান্য ঘটনা, কিন্তু অভিঘাত অসামান্য । ওই গ্রামে একটি অজ্ঞাতপরিচয় মৃতদেহ উদ্ধার হলে, তদন্তে আসে পুলিশ । স্বাভাবিক । কিন্তু এর পরের ঘটনা স্বাভাবিক নয় মোটেও । স্বাভাবিক তো নয়ই, বরং মানুষের হিংস্র বর্বরোচিত আদিম রূপটিকেও হার মানিয়ে দেয় পুলিশের কৃতকর্ম । এক পুলিশ অফিসার প্রকাশ্য রাস্তায় অজস্র দর্শকের সামনে বুট জুতো সমেত পায়ে করে ওই অজ্ঞাতপরিচয় মৃতদেহের আবরণ উন্মোচন করেন । সংবাদমাধ্যমের দৌলতে সেই ছবি প্রকাশ্যে আসে । সারা ভারতবর্ষ প্রত্যক্ষ করে একবিংশ শতাব্দীর মানবসভ্যতার রূপ ।
অযোধ্যা পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে রাজ্য পুলিশের ইন্সপেক্টর পার্থ বিশ্বাসের খুন হওয়া আমরা সকলেই জানি । এও জানি, ওঁর স্ত্রী ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্টের সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করে পুনরায় ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন করেছিলেন । সরকার তা করতে অস্বীকৃত হওয়ায়, ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীর দেহ (?) নিতে অসম্মত হয়েছিলেন । এত দূর অবধি ঠিক ছিল । কিন্তু শেষ খবর পাওয়া অবধি জানি, মানুষটির মৃতদেহ বাঁকুড়া জেলা হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে পড়ে আছে । কেন ? কোন আইনে ? ২০১০-এর ১৮ অক্টোবর নিখোঁজ হয়েছিলেন পার্থ বিশ্বাস । ২০১১-এর ১১ মার্চ মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছিল মৃতদেহ । পার্থ বিশ্বাসের স্ত্রী দেহ সনাক্ত করতে অসমর্থ হলে--আরেকবার ডিএনএ টেস্টে মহাভারত কতটা অশুদ্ধ হত, ঈশ্বর জানেন--আইনত দেহটি বেওয়ারিশ বলে গণ্য হয় । এখন, আইন বলছে, কোনও বেওয়ারিশ দেহ ১৫ দিনের মধ্যে সৎকার করে ফেলা উচিত । পার্থ বিশ্বাসের খবর এখন আর কোনও সংবাদমাধ্যমে দেখা যায় না । আমি জানি না সে দেহের সৎকার আজও সম্পন্ন হয়েছে কি না; যদি হয়েও থাকে, এত দীর্ঘ, দীর্ঘতর সময় ধরে সে দেহ লাশ কাটা ঘরে পড়ে ছিল কেন ? কী বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ? কী বলছে পুলিশ ? কী বলছে বিচারের বাণী ? মৃতকে অসম্মান করার এই স্পর্ধা কে দিয়েছে সভ্যতাকে ? নাকি সভ্যতারই মৃতদেহ পড়ে আছে লাশকাটা ঘরে ?

এই লেখকের এমনতরো নৃশংস দৃশ্যও চাক্ষুষ করার অভিজ্ঞতা আছে যে, আসানসোল-দুর্গাপুর লাইনে ট্রেনে কাটা পড়া এক যুবতী মায়ের মৃতদেহ স্রেফ ইগো আর আইনি জটিলতায় দীর্ঘ সময় পড়ে থাকায়, তাঁর ছিন্নভিন্ন শরীরের ওপর দিয়ে আরও কয়েকটা গাড়ি পরপর চলে গিয়েছে দিনভর । আমি জানি না পৃথিবীর আর কোথাও এমনটা ঘটে কি না ! কিন্তু যে দেশে ঘটেছে, তাকে কবি বলেছেন 'সকল দেশের রানি ।' সত্যি, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি !
আর নগরের ঝকঝকে বেসরকারি হাসপাতালে কোনও অকালপ্রয়াত রোগীর মৃতদেহ মোটা টাকা বকেয়ার দাবিতে দিনের পর দিন আটকে রাখার অসভ্যতা তো আকছাড় ঘটছে আজকাল । সংবাদপত্র খুললেই এ রকম খবর চোখে পড়ে । ইদানীং চিকিৎসাক্ষেত্রে লক্ষ-হাজার টাকার 'প্যাকেজে'র ব্যবস্থা হয়েছে । গরিব মানুষ জমিজমা বিক্রি করে বাঁচার আশায় ভর্তি হয় এই সব হাসপাতালে । দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত মানুষ মারা গেলে--ব্যধি যে দুরারোগ্য তা অনেক ক্ষেত্রে ভর্তির সময়ে আত্মীয়-পরিজনকে জানানো পর্যন্ত হয় না--বেশ কয়েক হাজার টাকা বকেয়া দাবি করে বসে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ । শোকদগ্ধ অসহায় মানুষের তখন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা--কোথায় পাবে টাকা ? আর এই সুযোগেই অসাধু ব্যবসায়ী আটকে দিচ্ছে মৃতদেহ--সৎকার করতে দিচ্ছে না । মৃতদেহে পচন ধরছে । গন্ধ ছাড়ছে । এ মৃতদেহ কার ? কার এ মৃতদেহ ? আসলে, এ দেহ কোনও ব্যক্তিবিশেষের নয়, হাজার বছর ধরে যে সভ্যতা মৃতকে সম্মান করতে শেখায়, এ মৃতদেহ তার ।
শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, শিল্পে, বিজ্ঞানে পৃথিবী এত উন্নতি করছে, অথচ মানবিকতায় মানুষ এত পিছিয়ে পড়ছে কেন ? কেন আমরা ফিরে যাচ্ছি সেই গুহা যুগে ? কেন আমাদের মনগুলি আজ এত দুর্ভিক্ষপীড়িত ? মৃত্যুর পর তো শত্রুও আর শত্রু থাকে না, আত্মাহীন দেহের সৎকারেই তো আমাদের পুণ্য । সেখানে অসম্মাননা জ্ঞাপনের ফল তো আমাদের ওপরেও বর্তাবে একদিন । একই পরিণতি তো আমাদের জন্যও অপেক্ষা করতে পারে । জর্জ সেলার (George Schaller)-এর একটি বিখ্যাত আবিষ্কারের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে এই মুহূর্তে । 'দ্য টাইগার অ্যান্ড দ্য ডিয়ার' বইয়ে তিনি হাতিদের মৃতদেহ সৎকারের অভিনব পদ্ধতির কথা আলোচনা করেছেন । সঙ্গী হাতির মৃত্যু হলে, অন্য হাতিরা লতাপাতা আগাছা দিয়ে মৃতদেহ ঢেকে দেয় । এ তাদের সভ্যতা ।
আমাদের সভ্যতা কি পশুরও অধম ?



Comments